ঋত্বিক এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি দশজন সাধারণের মতোও না বা দশজন মহান ব্যক্তিত্বের মতোও না — নিজেকে নানান ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে বাংলার বাঙালির সত্তাকে একজন স্রষ্টার দর্শন, যুক্তি, বিশ্বাস দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আজীবন। সেখানে বিন্দুমাত্র খাদ নেই, ভনিতা নেই, অন্ধত্ব নেই। বলা হয় 'সিনেমার জীবনানন্দ' বিন্দুমাত্র ভুল নয়। সত্যজিৎ রায় নিজের বক্তব্যেও অকপটে বলে গেছেন — 'ঋত্বিক মনে প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল - আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি।' সে পদ্মারপাড়ে শূন্য চেয়ে থাকা ভবা হোক বা প্যারাডাইস ক্যাফের ছিন্নমূল বেপরোয়া তরুণ — ঋত্বিক কোনদিনই নিজের সাথে আপোষ মেনে নেননি, ভোল বদলাতেও পারেননি। পারলে হয়তো কিছু সমাপতন সমরৈখিক সুরে আসত না। ঋত্বিক — ব্যর্থ — মদ — অবক্ষয়...
'অরূপকথা' ('বেদেনী') ছবির স্মৃতিচারণে কেতকী দত্ত — ‘শ্যুটিং শেষ হলে আমরা সুবর্ণরেখা স্নান করে ক্যাম্পফায়ার করতাম। সবাই একসঙ্গে খাওয়া থাকা। মাঝে মাঝে চলত ছেলেদের মধ্যে কান্ট্রিলিকার। ঋত্বিককে একবিন্দু খাওয়ানো যেত না।'
যে মানুষ মধ্যপানকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন, অ্যান্টিমদ, মদ খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এসবের বিরোধিতায় প্রচার অবধি করছেন ; সেই শেষমেশ নিজেকে মদের ভিতর ডুবিয়ে দিচ্ছেন — কেন? তিনি ব্যর্থ? দিশাহীন? বিপর্যস্ত?
সাল ১৯৫৮ — অযান্ত্রিক রিলিজ করল। দীর্ঘ অপেক্ষা, পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণের পর যখন ছবিটি যত্ন সহকারে দর্শকের হাতে তুলে দেওয়া হল, তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হল। অথচ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সাব-টাইটেল ছাড়াই দায়সারা ভাবে পাঠানো ছিবিটি স্পেশাল এন্ট্রি হিসেবে দেখানো হল। অপ্রত্যাশিত প্রশংসা এবং উত্তেজনায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল সমস্ত পত্রপত্রিকা। প্রযোজক নিজেও বলেছেন নিজেও বলেছেন ছবি বানাতে গিয়ে আটবার চিত্রনাট্য বদলেছেন, বহু কাটাছেঁড়া করেছেন। তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর অতৃপ্তি; তিনি দর্শক এবং ছবিওয়ালাদের এমন একটা ছবি উপহার দিতে চেয়েছিলেন যা বাংলার তথা বিশ্ব চলচিত্র জগতে একেবারেই আনকোরা, অপরিচিত। হলও তাই। ছবি দেখলেই বুঝবেন সুবোধ ঘোষের বিমল - যে ছিল নেহাতই একজন মানুষ, যে তার গাড়ি জগদ্দলকে প্রেমিকার মত ভালোবাসে - এবং যন্ত্রের মধ্যে জীবন আরোপিত করা - যা ছিল গল্পটির মূল বিষয়বস্তু। ঋত্বিক এ-ভাবনাটিকে মেনে নিয়েও তার ছবির প্রোটাগনিস্ট বিমলকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে আটকে রাখলেন না; বাস্তব-পরাবাস্তবের একটা পূর্ণ সার্কেলে বাঁধলেন, তাকে আর্কিটাইপ বানিয়ে ছবিতে তুলে ধরলেন। তবু ছবিটি রহস্যময় দিকটি আর ভাঙতে পারল না, সর্বজনগ্রাহ্য হল না। এসব ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই অনেক বাধা প্রাচীর আষ্টেপৃষ্টে দমন করতে লাগল ঋত্বিককে। একরকম ভয়ঙ্কর ভেঙেই পড়লেন। এই ভেঙে পড়া যে হতাশা বা বিমর্ষতা তা কিন্তু না। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ষড়যন্ত্রের ঘন কালো মেঘ বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর অগোচরে। একদিকে ছবি ফ্লপ হয়ে যাওয়া অন্যদিকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া - এসবের মূলে কে বা কারা ছিল তা আশা করি আজ আর কারো অবিদিত নয়। প্রচার করা হল ঋত্বিক ঘটক হলেন পলিটিক্যালি ডেনজারেস এলিমেন্ট; তিনি ডায়াবোলিক্যাল মোটিভ নিয়েই পার্টিতে ঢুকেছেন। প্রায় একবছর নানান সাজানো অভিযোগ ড্রামার পর জানানো হল তিনি কোনোদিনই পার্টি মেম্বার ছিলেন না, ভুল করে তাঁর নামটি সদস্য হিসেবে উঠে এসেছিল — বের করে দেওয়া হল।
এভাবেই, 'নাগরিক' মুক্তি না পাওয়া, পার্টি থেকে ড্রপ করা, বোম্বাই থেকেও একরকম নৈরাশ্য নিয়েই ফিরে এসেছিলেন, সঙ্গে অযান্ত্রিকের বিফলতা, 'কত অজানারে' শেষ না হওয়া, আর্থিক অবনতি এসবের পরও তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠতে চেয়েছেন, অপেক্ষা করেছেন যোগ্য জবাব দেওয়ার। এক এক করে প্রায় সবরকম ভাবেই ব্লক করা হল ঋত্বিককে। দেখিয়েও দিয়েছেন, 'মেঘে ঢাকা তারা' 'সুবর্ণরেখা' সমস্ত মুখকে নিমেষে ম্লান করে দিয়েছিল তবু পাঁচিলগুলো ভেঙে ফেলতে পারেননি। নানান অ্যাফেকশনের পাশাপাশি মদ্যপানটিও রয়ে গেল তাঁর জীবনে। উত্তরোত্তর সেটাই জীবনে নিদারুণ ভাবে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। তাঁর সমস্ত ইমেজের সঙ্গে বারবার মিশিয়ে দেওয়া হল মদকে। যতটা না পরিচালক ঋত্বিক, তার চেয়ে বেশি মাতাল ঋত্বিক এই ধারণাটা বিভিন্ন কথাবার্তায়, সাক্ষাৎকারে, লেখায় ছড়িয়ে দিতে থাকল তাঁর পরিচিতরাই।
হরিসাধন দাশগুপ্ত পরবর্তীতে একটি লেখায়, 'বন্ধু ঋত্বিক প্রসঙ্গে' লিখেছেন — 'আমি জানি ও মদ্যপান ভীষণ ভাবে ঘৃণা করত। কিন্তু শেষকালে সেটাই হল তার কাল। ও দুঃখ ভুলে থাকার বা ব্যর্থতার জন্যে মদ্যপান করেনি, কারণ ঋত্বিক ব্যর্থ হয়নি। ও মদ্যপান করেছে inhabitation (অর্থাৎ মৌলিক ভদ্রতা) হারিয়ে পৃথিবীর ইতর লোকগুলোকে গালাগাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু ঋত্বিকের ইচ্ছে ওকে সাহায্য করতে পারল না, আস্তে আস্তে সর্বনাশের দিকে টেনে নিয়ে গেল। শেষের দিকের ছবি যত গুরুত্বপূর্ণ হতে শুরু করল ঋত্বিক তত ইনকনসিস্টেন্ট হতে শুরু করল। তখন ওকে ঘোরানো যায়? ওর ভিতরে যে আগুন ছিল — যা দিয়ে ও সবরকম দুর্নীতি ম্লান করতে পারত, সেই আগুনই ওকে গ্রাস করে ফেলল। যেমন হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলায়।'
আরও পড়ুন
নিচে আদিগন্ত পদ্মা, বিমানে বসেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ঋত্বিক
তবু ঋত্বিককে যদি একবার ডি-কোড করা যেত বা তাঁর সরলরৈখিক থটগুলোকে কীভাবে সর্বজনগ্রাহী করে তোলা যায় এমন ধারার সমালোচনা হত তাহলে হয়তো ঋত্বিকে ফেরানো যেত। মোট কথা তিনি কী চেয়েছিলেন, তাঁর বাংলার আপন হতদরিদ্র মানুষের মায়ের কান্না যন্ত্রণাকে মানুষের সামনে আয়নার মতো তুলে ধরতে অথচ তাকে বানিয়ে দেওয়া হল সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের চলচ্চিত্রকার। এভাবেই জীবনের সঙ্গে প্যারালালভাবে মদ এবং ঋত্বিক ও ঋত্বিক এবং মদ তাকে টেনে নিয়ে গেল 'যুক্তি তক্কো গপ্পো' যা হয়তো তিনি নিজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই ক্যামেরার উপর মদের বোতল ঢেলে দিয়ে একবুক চাপা অতৃপ্তি, অভিমান, কান্নায় যেন অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নিজের অন্তিম মুহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করে গেলেন, বলে গেলেন শেষ কথাগুলো —
— ‘দুগ্গা! দু- গা- গা... সব পুড়ছে, ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমিও পুড়ছি...
মানিকবাবুর সেই মদন তাঁতির কথা মনে আছে তোমার, ওই যে বলেছিল, ভুবন মহাজনের টাকায় সুতো কিনে আমি তাঁত চালাব? তোদের সাথে আমি বেইমানি করব!
তাঁত না চালিয়ে পায়ে গাঁটে বাত ধরে গেছে...তাই খালি তাঁত... খালি তাঁত চালালাম আর কী...খালি তাঁত!
কিছু একটা করতে হবে তো!’
তথ্যসূত্রঃ Cinema and I, Ritwik Ghatak
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রীণা চক্রবর্তী
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
Powered by Froala Editor