ঋত্বিক কুমার ঘটক বাঙালির সংস্কৃতির অভিজ্ঞানে এমন এক বিস্ময়-পৃথিবী, যার সমতুল কোনও উদাহরণ আজও একটা গোটা জাতির আয়ত্তের অতীত। অত্যুক্তি নয়, বরং সময়ের প্রেক্ষিতে ঋত্বিকের অভিপ্রায়, উদ্দেশ্যসিদ্ধির মাধ্যম এবং সেই মাধ্যমের বৈপ্লবিক প্রয়োগগুলিকে আমরা যত খুঁটিয়ে দেখেছি, বিচার করেছি, তত বুঝেছি, সর্বার্থে আধুনিক এক মানুষ কীভাবে সময়ের ধারণা ভেঙে এগিয়ে যান মানবের দিকে। এগিয়ে যান শাশ্বত বোধির দিকে। ঋত্বিক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাই নবারুণ যখন অশ্রু-আকুল হন, বলেন, চোখের সামনে স্বয়ং বুদ্ধকে ঘুরতে দেখেও সেদিন তিনি চিনতে পারেননি, আমরাও যেন আর-একবার বুঝতে পারি, এক চিরদিনের শিক্ষক আমাদের অপেক্ষায় আজও বসে আছেন। মানুষের ক্রমমুক্তির বোধি নিয়ে।
আরও পড়ুন
আশি বছর আগেই আফ্রিকায় শ্যুটিং করেছিলেন এই বাঙালি পরিচালক
প্রকৃত-প্রস্তাবে ঋত্বিক ছিলেন এক শিক্ষকই। চলচ্চিত্রকারের ছদ্মবেশ যে ছলনার জন্ম দেয়, তাকে তিনি নিজে হাতেই তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। গল্পকার, নির্দেশক ঋত্বিক জানিয়েছিলেন, বৃহত্তর যোগাযোগের অন্য মাধ্যম পেলে সিনেমার দিকে তিনি ফিরেও তাকাবেন না। সেই হিসেবে গণশিল্পী অভিধা হয়তো ঋত্বিককে অনেকখানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু, সিনেমার দিকে যতদিন তাকিয়েছিলেন ঋত্বিক, ততদিন এই মাধ্যমটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন উৎকর্ষের অমরাবতীতে। তাঁর বিখ্যাত সব ছাত্রদের স্মৃতি সাক্ষ্য দেয়, কী ব্যাপক ও বৈপ্লবিক ছিল ঋত্বিকের সিনেমা-ভাবনা। কেউ কেউ তো আক্ষেপ করেন, ক্লাসনোট না রাখার জন্য।
তা কেমন ছিল শিক্ষক ঋত্বিকের ক্লাস? একদমই ক্লাসমাফিক নয়। বস্তুত নয়ই। তাঁর অন্যতম ছাত্র, কুমার সাহানি জানান, ঋত্বিক ছিলেন 'রাজাধিরাজ'। আর নবরত্নের মতো তাঁকে ঘিরে থাকত প্রিয় ছাত্ররা। হয়তো কাউকে একটা রাগ বাজাতে বললেন। তারপর সেই সূত্র ধরেই ঢুকে পড়লেন পরিচালনার খুঁটিনাটিতে। দিনভর চলছে নানা আলোচনা। আবার হয়তো নির্দেশ দিলেন, কাল প্রথম আলোর শট নেবেন। পাহাড়ের উপর বসে বুঝিয়ে দিতেন, কেন এই আলোটাই চাইছিলেন। তার কম্পোজিশন, সেখানে কী কী সম্ভাবনার শিল্প লুকিয়ে আছে, বুঝিয়ে দিতেন তা-ও। এভাবেই চলত ঋত্বিকের ক্লাস।
তাঁর ছবির একটা অন্যতম প্রধান উপাদান শব্দ। বস্তুত ঋত্বিকের সিনেমা-দর্শনের ভিত্তি বলা যায় এই শব্দ ও সংগীতের প্রয়োগ। এবং, এই নিরিখেই তিনি পৃথক হয়ে যান সত্যজিতের থেকে। শব্দের ভাবনায় তাঁরা দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। ঋত্বিক তাঁর ছাত্রদেরও চিনিয়ে দিয়েছিলেন এই শব্দ ও সংগীত। একবার, পুনেরই কুখ্যাত কোনো জায়গায় মাঝরাতে মদ খুঁজতে বেরিয়েছেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। একদিকে শৌচাগার। এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে যৌনকর্মীরা। তার মধ্যে ঋত্বিকের থমকে যাওয়া দেখে কুমার সাহানি অবাক। আর, ঋত্বিক তখন শোনাচ্ছেন, পাশেই কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসা আশা ভোঁসলের গান। পাঞ্জাবি লোকগানের সুর। তারিফ করছেন আশাজির। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথন কালে সাহানি জানিয়েছেন, এভাবেই ঋত্বিক বেঠোফেন বা অন্য সংগীত শুনতেন। আসলে কোলাহলকে, নয়েজকে তিনি ফেলে দেননি। আবিষ্কার করেছেন তার অন্তস্থঃ সংগীতকে। এটাই ঋত্বিকের শিক্ষা। এই তাঁর ক্লাস।
‘গোটা পৃথিবীকে দেখার চোখ এবং আদর্শবাদ যাতে এমন না হয় যে, দমবন্ধ হয়ে আসে, একে অন্যের মধ্যে কাব্য খুঁজে পাওয়াটা অবধি ভুলে যায়,’ সাহানি যখন এ-কথা বলেন, আমরা ধরতে পারি তাঁর প্রিয় শিক্ষক ঋত্বিকের শিক্ষার নির্যাস। এভাবেই তো ঋত্বিক নিজে পাঠ নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। ভারতবর্ষের ইতিহাসের। আবার মার্কসিয় দর্শনের। সেই মুক্তপাঠ-ই পথ করে দিয়েছে ঋত্বিককে। সেই অভিজ্ঞান তিনি তুলে রেখে গিয়েছেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে। সন্দেহ নেই, আজকের দুসময়ে এই অতি মূল্যবান অঙ্গুরীয়টি চিনে নেওয়া, আমাদের একান্ত জরুরি।
ঋণ : ঋত্বিক উপনিবেশ / সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, কুমার সাহানি
Powered by Froala Editor