চাকরি ছেড়ে প্রথমে স্ক্রিপরাইটার, তারপর পেশাদার অভিনেতার জীবন। তাঁর 'এফর্টলেস' অভিনয় কি সত্যিই এফর্টলেস? সিনেমা, জীবন ও স্বপ্ন নিয়ে অকপট ঋত্বিক চক্রবর্তী। শুনলেন অরিত্র দত্ত।
আপনার অভিনয় শুরু থিয়েটারের হাত ধরে। সেখান থেকে রুপোলি পর্দায় আসা – এই জার্নিটা ঠিক কেমন?
দেখুন, পেশাদার অভিনয়ে আসাটা কিন্তু পরে। এর আগে আমাদের একটা থিয়েটারের গ্রুপ ছিল। সেটা কলকাতার দলগুলোর মতো বেশি শো করতও না। কিন্তু একটা চর্চা ছিল দীর্ঘসময়। আমরা টানা রিহার্সাল করতাম। তখন থেকে ভালো অভিনয় এবং খারাপ অভিনয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিলই। আমি চাকরি করি প্রায় তিন বছর। কিন্তু পরে বুঝতে পারি চাকরিটা আমি করতে পারব না। কারণ, এটা তো আমি চাইই না, ধীরে ধীরে ক্রাইসিসটা বাড়তে থাকে এবং চাকরিটা ছেড়ে দিই। ছেড়ে তো দিলাম তারপর? টালিগঞ্জে ডেইলিসোপে তখন স্ক্রিপ্ট লেখা আরম্ভ করি। তবে শুরু থেকেই এটা পরিষ্কার ছিল যে আমি কিন্তু অভিনয়টাই করতে এসেছি। আমাকে স্ক্রিপ্ট লেখাটা থামাতে হয়। কারণ, বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব বলেন যে স্ক্রিপ্ট লিখতে লিখতে যদি অভিনয় করি তবে লোকে সেটাকে শখ ধরে নেবে এবং আমার পরিচিতি চিত্রনাট্যকার হিসেবেই থেকে যাবে। অর্থাৎ অভিনয়টাই ফুলটাইম হোক। আমাকে তখন সেই ডিসিশনটা নিতে হয়।
রাষ্ট্র আমার থেকে শুধু ভোট চায়, তার বাইরে কোনও চাহিদা নেই আমার কাছে
আপনি বললেন যে ‘ভালো অভিনয় এবং খারাপ অভিনয়’ নিয়ে আপানার ধারণা ছিল খুব স্পষ্ট। এই বোঝাপড়াটা তৈরি হয়েছে কীভাবে?
অবশ্যই ছবি দেখে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, আমরা যখন বড় হচ্ছি সেটা হল আশির শেষ দিকে বা নব্বইয়ের শুরু। আজকের একটা ক্লিকেই সব পাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো অতটা সহজ ছিল না। বাড়িতে ভালো সিনেমা দেখার একটা চর্চা ছিল তো বটেই। একটা বয়সের পরে গিয়ে বোধ তৈরি হয়, বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়, আলোচনা করার পরিসর তৈরি হয়। এই সময় ভালো ছবি দেখার জায়গাটা বাড়ে, নতুন নতুন তথ্যও আসতে থাকে। এইভাবেই, খুব আলাদা কিছু না।
এবারে একটু সাম্প্রতিকে ফিরি। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-র মুক্তি তো সামনেই। শরৎচন্দ্রের ক্লাসিক থেকে সিনেমা। অথচ, ট্রেলার দেখেই বোঝা যাচ্ছে সিনেমার সময় ও সাহিত্যের সময়টা এক নয়। সময় বদলেছে মানেই উপন্যাসের শ্রীকান্তও সিনেমায় এসে নিজেকে বদলেছে। এই চরিত্রে অভিনয়ের সময় আপনার কাছে ব্রিফটা ঠিক কেমন ছিল?
প্রদীপ্ত যখন কোনও স্ক্রিপ্ট লেখে তখন সেখানে প্রতিটা চরিত্র নিয়ে ওর যা মনে হচ্ছে সেটাও নিজের মতো লিখে রাখে। এমনটাও নয়, সেই লেখার গোটাটাই স্ক্রিপ্টে থাকবে। অনেকটা ব্যাকস্টোরিও লেখা থাকে সেখানে। যখন আমি শ্রীকান্তর স্ক্রিপ্ট পাই সেখানেও এমন লেখা ছিল। শ্রীকান্তকে আমরা চিনি আবার পুরোপুরি চিনিও কি? এমন চরিত্রকে কেউ এক লাইনে বলে দিতে পারে না। সেখানে স্ক্রিপ্টের ব্রিফ এবং নিজের চিন্তা সবটা মিলিয়ে অভিনয় করতে হয়। সময়ের যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমন কিছু জিনিস তো আবার একও আছে। এই সময়ের শ্রীকান্তর মোবাইল আছে, সেখানে ঘটনা কিছুটা আলাদা। আবার শ্রীকান্তর বড় হওয়াটা গ্রামে সেখানে গ্রামজীবনের বিশাল পরিবর্তনও হয়নি। তেমনই রাজলক্ষ্মীদের জীবনের কিছু বিশাল মাপের পরিবর্তন হয়নি। কিছু জিনিস এক হয়ে যায়। মিল যেমন আছে অমিলও প্রচুর। ফলে বলা যেতে পারে সেই শ্রীকান্ত যেমন আছে আবার সেই শ্রীকান্ত নেই। কোথাও গিয়ে এই ছবিটা চিরকালীনও যেমন, একইসঙ্গে সময়োপযোগীও বটে।
আরও পড়ুন
'মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই' - প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্যের সাক্ষাৎকার
সময়োযোগী বলতে মনে পড়ল। এখন তো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আর ওয়েব সিরিজের যুগ। বলা যেতে পারে, বাস্তবটা অনেকটাই সিনেমা হল বনাম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াচ্ছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কী মনে হয়?
আমি এখন বলার মতো জায়গাতেই নেই যে ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। তবে এটা ঠিক, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এসে যাওয়ায় মানুষের কাছে অনেক বেশি অপশন আছে এখন। কোথাও হয়তো মানুষ একা দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তবে এটা তো ঠিক, সিনেমা হলেই দেখুন বা নেটফ্লিক্সে, সিনেমা তো থেকেই যাবে। সেই শিল্পমাধ্যমের ওপর কোনও প্রশ্নই নেই। যদি একটা সিরিজ নেটফ্লিক্সের জন্য তৈরি হয় সেখানে পাওনা হল তৈরি তো হচ্ছে, কাজটা ভীষণ ভালোও তো হচ্ছে। আর যদি প্রশ্ন হয় বড় পর্দা না ছোট পর্দা কিংবা বড় পর্দা আদৌ থাকবে কি না – তাহলে বলব উত্তরটা দেওয়ার সময় আসেনি এখন। আমার ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয়, এইসময়টা খুব জটিল সময়। তবে হ্যাঁ, সিনেমার পর্দা পরিবর্তন হলেও সিনেমা জিনিসটা কিন্তু উঠে যাচ্ছে না। বিগত কয়েকবছরে মানুষের ছবি দেখার ভাষাটাও পরিবর্তন হয়েছে এটাও মাথায় রাখতে হবে।
এখনকার বাংলা সিনেমা নিয়ে কী মত আপনার?
বাংলা সিনেমা অনেকটা পথ এসেছে আবার অনেকটা যেতেও হবে। বাংলায় এখন অনেকেই কন্টেন্টের দিকে মনোনিবেশ করছেন। যার জন্য আমাদের মতো অভিনেতারা সুযোগ পাচ্ছেন। চরিত্রের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। উল্টো করেও বলা যায়, হয়ত দর্শকই বাধ্য করেছে। একটা জিনিস তো ঠিক, কপি সিনেমা প্রচুর হয়েছে এবং হয়ও। প্রযোজকরা চেয়েছেন তাই হয়েছে। এখন মানুষ কিন্তু সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। যেমন রাজ (চক্রবর্তী) কিছু ছবি যেমন দক্ষিণী ছবি থেকে নিয়েছে আবার সেগুলোকে পুরোপুরি কপিও যে করছে তা তো না। ‘প্রেম আমার’-এর কথাই ধরা যেতে পারে। সেরকমভাবেই কন্টেন্টের ওপর জোর দেওয়াটাও কিন্তু আশার আলো। তাতে অভিনেতারা আগের থেকে অনেক বেশি নিজেদের মেলে ধরতে পারছেন। ‘পরিণীতা’র গল্পটাও যেমন রাজের অন্যান্য সিনেমার থেকে অনেকটাই আলাদা।
সিনেমা পরিচালনার ইচ্ছে আছে নাকি?
সিনেমা বানানোর ইচ্ছেটা কোনদিনই যে ছিল না, তা নয়। ছিল। কিন্তু সে অনেক আগে। এখন এই নিয়ে সেভাবে ভাবিনি। কারণ, আমার সত্যিই কিছু বলার নেই এখন। এখন প্রচুর শর্টফিল্ম হচ্ছেও। সব যে ভালো তা নয়, তবে ক্ষতিও তো হচ্ছে না। এখন সেই সময়টা এসে গেছে, যেখানে সবই সহজলভ্য। সব দর্শকের জন্যই বানানো হয়ছে। খারাপ হলে সেটা ঢাকা পড়ে যাবে। এর ভালো দিক হল, যে একটা চর্চা জারি থাকছে। মানুষ সিনেমার এই ভাষাটা শিখতেও চাইছে এবং কত নতুন নতুন কাজের সুযোগ হচ্ছে। আর খারাপ দিকটা অতটা ইম্পরট্যান্ট নয়। আরে এতে তো কারও ক্ষতি হচ্ছে না! হোক না কাজ। আজ কবিতা লেখার মতো সিনেমা বানানোটাও সহজ হোক না!
আরও পড়ুন
'এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন' - সাত্যকি ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার
মাঝে মাঝে প্রচণ্ড খারাপ লাগে, আমার রাষ্ট্র আমার থেকে শুধু ভোট চায়, তার বাইরে কোনও চাহিদা নেই আমার কাছে। তার থেকে ফিল্ম হওয়াটা খুব ভালো তো।
আপনি বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। সব থেকে প্রিয় পরিচালক কে?
প্রিয় বলাটা মুশকিলের। প্রত্যেকেরই তো নিজের একটা ধরন থাকে। যেমন, প্রদীপ্ত একজন অভিনেতাকে প্রচুর স্পেস দেয়। একটা শট যখন ধরে নেওয়া হয়, সেখানে কোথাও গিয়ে অভিনেতা নিজের মতো অভিনয়টা করতে পারে। আবার যখন বিক্রমের সঙ্গে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ করছি, সেখানে একটা শট কুড়ি-একুশ বারও দিতে হয়েছে। কারণ, তার সেই শটটা লাগবে। কৌশিক গাঙ্গুলি নিজে একজন বিশাল মাপের অভিনেতা। তাঁর সিনেমায় অভিনয় করতে গেলে তাঁর ব্রিফটা খুব দরকারি। তিনি অনেক বেশি টেকনিকাল। তো এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে করা কাজই কিন্তু আমাকে ঋদ্ধ করেছে।
কোনও একটা চরিত্র হাতে এলে সেটা নিয়ে মানসিক শ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অভিনয়ে সেই শ্রমটাকে লুকোতেও হয়।
আপনি আর অপরাজিতা দুজনেই তো ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমায় রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে আপনাদের আলোচ্য বিষয়গুলোতেও কি সিনেমা অনেকখানি জুড়ে থাকে?
আমরা দুজনেই অভিনয়ের মানুষ হলেও নিজেদের কাজ নিয়ে বিশাল আলোচনা হয় না তেমন। কিন্তু আমরা অভিনয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা করি। সেখানে অপরাজিতার অভিনয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যেমন আমাকে পরিণত হতে শেখায়, তেমনই ওঁর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম।
ইদানীং কান পাতলেই শোনা যায়, টলিউডে ‘এফর্টলেস’ বা ‘ন্যাচারাল’ অভিনয়ে আপনার সমকক্ষ এখন বিশেষ কেউ নেই। প্রশংসার দিকটা বাদ থাক নাহয়। কিন্তু এই যে ‘এফর্টলেস’ ন্যাচারাল অভিনয়, এটা কি সত্যিই খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে আপনার ভিতর থেকে? নাকি এটাও পরিশ্রমলব্ধ?
শিশির ভাদুড়ী একজায়গায় বলেছিলেন, আমিই যদি রাম হয়ে যাই তবে লাইটটা নেবে কে? অর্থাৎ, অভিনয় করার সময় অনেকগুলো জিনিস মাথায় রাখতে হয়। বিলীন হওয়া যায় না কখনওই। এটা একটা ভয়ঙ্কর টেকনিক্যাল জিনিস। তোমার দুঃখ না পেলেও চলবে কিন্তু পর্দায় তোমাকে দেখে যেন মনে হয়, তোমার সত্যিই ভীষণ দুঃখ হয়েছে। সেরকমই কোনও একটা চরিত্র হাতে এলে সেটা নিয়ে মানসিক শ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অভিনয়ে সেই শ্রমটাকে লুকোতেও হয়। একজন লেখকও কিন্তু তার শ্রম লুকতে চান। ধরা যাক, আমি একটা শট দিচ্ছি। এবার বাইরে থেকে দেখে মনে হল, শটটা ঠিকঠাকই হয়েছে। কিন্তু মনিটরের সামনে বসতেই দেখা গেল, অভিনয়টা হয়নি। আমি যখন অভিনয় করছি তখন আমার মাথায় শুধু ক্যামেরা না, তার সঙ্গে লাইট ইত্যাদি সবই থাকছে। সেই যে মাথার মধ্যে শ্রম সেটাই লুকোতে চাই। যে কোনও শিল্পী যে এফর্ট দিয়েছেন, সেটাকে তিনি লুকোতে চান। সেখানেই এফর্টলেস হয়ে যায় অভিনয়টা।
একসময় যখন কাজ ছিল না তখন যে চরিত্রই দেখতাম মনে হত, এটা যদি আমি করতাম!
আপনি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করেছেন, এমন কোনও চরিত্র আছে যেটা আপনার শেষ অভিনয় হলে ক্ষতি নেই?
এই রে, এমনটা বলাটা খুব মুশকিল। আসলে আমি নিজে আরও কুড়ি-পঁচিশ বছর অভিনয়টা করে যেতে চাই। আসলে একসময় যখন কাজ ছিল না তখন যে চরিত্রই দেখতাম মনে হত, এটা যদি আমি করতাম! শেষ অভিনয় করার কথাটা আসেই না। তবে হ্যাঁ, এখনও অবধি বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে কাজ করেছি। বিভিন্ন চরিত্র করতে গিয়ে অনেক জিনিস শিখিও। সেটা খুব চ্যালেঞ্জিং। যেমন ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’-তে আমার লিপ সিঙ্ক আছে, সেটা আমার মতো তাল-ছন্দহীন মানুষের কাছে খুব কাছের। আমি এর আগে মাত্র একবার ‘ছায়া ও ছবি’-তে লিপ সিঙ্ক করেছি। যেটা পুরোটা একটাই শটে নেওয়া হয়েছিল। এখানে এই কাজটা খুব মজা দিয়েছে।
আর যদি বলেন স্বপ্নের চরিত্র কী, তাহলে হবে 'অযান্ত্রিক'-এ। সেটা কিন্তু যদি ঋত্বিকবাবু করেন তবেই।
ছবি ঋণ - প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য