আকাশ থেকে যখন তারা খসে পড়ে, তখন কেবল একটা আলো নিভে যায়। শব্দ হয় না। আকাশে তখনও অনেক বিন্দু বিন্দু আলো থাকে, তাই হয়তো অভাবটা চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু আকাশে যদি কয়েকটা মাত্র তারা থাকে, তাও এক্কেবারেই হাতে গোনা? তবে খানিক চোখে লাগে আর শব্দও হয়। সে শব্দ আত্মার আক্ষেপের শব্দ।
নারীসুলভ পুরুষদের কতকটা বিদ্রুপের চোখেই দেখে আমার সমাজ। যার নেপথ্যে রয়েছে চিন্তার অভাব, কিছুটা অশিক্ষাও বটে। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে ওই নারীসুলভ সত্তাই হয়ে ওঠে শক্তি। তেমনই একজন হলেন ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh)। ছিলেন বলা উচিত ছিল বোধহয়, কিন্তু স্রষ্টাকে কি অতীততে পাঠিয়ে দেওয়া যায়? তাও ওঁর মতো এক স্রষ্টাকে। না, সম্ভব নয়!
হীরালাল থেকে ঋত্বিক, মৃণাল, সত্যজিৎ, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার - কত নাম করব, শেষ হবে না। এমনই তারকাখচিত আমাদের চলচ্চিত্রের আকাশ। কিন্তু কোথাও গিয়ে এক সময় সে আকাশ আঁধারে ঢেকেছিল। তখনই কোন একজনের ধ্রুবতারা হয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। হ্যাঁ অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা ছিলেন, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিতরা কোথাও বেড়ে উঠছিলেন কিন্তু একটা স্ফুলিঙ্গের দরকার ছিল। যে মশাল হাতে কিছুক্ষণ লড়াইটা দিয়ে যাবে, পরের জনের হাতে বারুদ ঠাসা মশাল ধরিয়ে দিয়ে বলবে - যাও এবার তোমার পালা। ওই স্ফুলিঙ্গের নাম ঋতু।
আমাদের বাঙালিদের আইকনের অভাব নেই, সবক্ষেত্রেই একটি করে ঈশ্বর। লাইটস, ক্যামেরা, অ্যাকশনের ঈশ্বর সত্যজিৎ। ঋতুপর্ণ বলে গিয়েছেন, তাঁর জীবনে মানিকের প্রভাব ছিল। তাই তো উৎসবের শুরুতেই নিজেই নিজের চরিত্রকে দিয়ে বলাচ্ছেন ঠিক যেন 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর প্রথম দৃশ্য। সেই দৃশ্যই পুনর্নির্মাণ করেছেন। আবার 'অন্তরমহল' এবং 'সব চরিত্র কাল্পনিক'-এ সত্যজিতের 'দেবী' ও 'চারুলতা'র ছোঁয়া পাওয়া যায়। ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানির ঘর অনেকটাই মানিকবাবুর ঘর হয়ে ওঠে, 'হীরের আংটি'তে একটু হলেও তরুণ মজুমদারের ছোঁয়া দেখা যায়। 'বাড়িওয়ালি'তে মৃণালে সেনের 'আকালের সন্ধানে'-র প্রভাবের ছাপ স্পষ্ট। অর্থাৎ ওঁরাই ঋতুর দ্রোণাচার্য।
আরও পড়ুন
ঋতু-বিসর্জনের উৎসব
তাঁর কাজে রবীন্দ্র-প্রভাব একটা মস্ত জায়গা জুড়ে ছিল। নিজের ছবি 'রেনকোট'-এ ব্রজবুলি ভাষার শব্দকে ছন্দে মোড়েন ঋতুপর্ণ। এই ব্রজবুলিতেই সেজে উঠেছিল রবি ঠাকুরের ভানুসিংহের পদাবলী। 'নৌকাডুবি' হোক বা 'চোখের বালি', রবীন্দ্রনাথের চরিত্রদের নিজের মতো করে পর্দায় মেলে ধরেওছেন ঋতু। 'গানের ওপারে'র কথা মনে পড়ে? ভাষার সীমা ছাড়িয়ে হলেও, এমন ধারাবাহিক কটা হয়েছে দেশে? ওই ধারাবাহিকেও ঋতুপর্ণের রবীন্দ্রপ্রেম স্পষ্ট। সাহিত্য বারবার উঠে এসেছে ঋতুর ছবিতে - 'দহন' হোক বা 'ব্যোমকেশ'; লম্বা সে তালিকা।
আরও পড়ুন
‘দোসর’ নিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে হাজির ঋতুপর্ণ, ‘বাবার মুখের মতো’ প্রতিক্রিয়া দর্শকদের
তবে ওঁর ছবির সবচেয়ে বড়ো শক্তি হল সম্পর্ক। নারীসুলভ সত্তাই এখানে তাঁর শিরদাঁড়া হয়ে উঠেছিল। অনুরাগীরা তো বলেনই, এমনকি সমালোচকেরাও বলেন মেয়েদের খুব ভালো বুঝতেন ঋতুপর্ণ। তাঁর ছবির ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে বারবার সম্পর্কের টানাপোড়েন এসেছে, মূলত নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিভিন্ন বয়সী মহিলাদের বিভিন্ন সম্পর্ক, তার সমস্যা-জটিলতা, অন্য মানুষকে কীভাবে দেখছে সে। 'তিতলি'তে মা-মেয়ের একই পুরুষের প্রতি জীবনের কোন না কোন সময়ে আকৃষ্ট হওয়া, সেই পুরুষ মায়ের প্রাক্তন জানার পরে মেয়ের অভিব্যক্তি। আবার 'উনিশে এপ্রিল'-এ এক রকম মা-মেয়ের সম্পর্ক। দোসর, উৎসব, সব চরিত্র কাল্পনিক, শুভ মহরৎ - স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে অন্য মলাট দিয়েছেন প্রতিবারই। 'বাড়িওয়ালি'তে মধ্য বয়সে পৌঁছনো অবিবাহিত মহিলার জটিল জীবন যন্ত্রণার ক্যানভাস আঁকা। 'আবহমান'-এ গোটা পরিবারের আরেক টানাপোড়েন, অসুখের আরেক রকম; আদপে সম্পর্ককে সত্যিই খুব ভালো বুঝতেন ঋতুপর্ণ। হয়ত একাকীত্ব ওঁকে অনেকখানি সময় দিয়েছিল জীবনকে নিবিড়ভাবে দেখার। ছোটো ছোটো জিনিসগুলোকে ধরার। বাংলা ছবিতে সমকামিতাকে পূর্ণ মাত্রায় মেলে ধরার পথিকৃৎ তিনিই। এও তো সমাজের টানাপোড়েনই। কারণ সমলিঙ্গ সম্পর্ক, সমাজের একটা বড়ো অংশের কাছে আজও ভ্রু কুঁচকে দেখার বিষয় হয়ে রয়েছে। কেবল নারী হয়, সম্পর্কের প্রতি পুরুষের উপলব্ধি বদলে যাওয়াও ধরা দেয় ওঁর ছবিতে, খেলা ছবিটিই তার উদাহরণ।
আরও পড়ুন
'দরদ' শব্দটির জ্যান্ত মানুষরূপ মনে হয় ঋতুকে
ছবিকে অনেকেই দুটো ভাগ করেন, আর্ট ফিল্ম আর বাণিজ্যিক ছবি। সব ছবিতেই শিল্প রয়েছে, আর প্রতিটি ছবি তৈরির উদ্দেশ্যই উপার্জন। আমি ভাগ করি বাস্তব ছবি আর কল্পনামিশ্রিত ছবি। নায়ক ৩০ জনকে মেরে দিচ্ছেন একই সঙ্গে, আবার হঠাৎই সুইজারল্যান্ডের বরফ ঢাকা পাহাড়ে গেয়ে বেড়াচ্ছেন, এ ছবিকে কল্পনামিশ্রিত ছবি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! নিঃসন্দেহে এই ছবিরও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ চলচ্চিত্র মাধ্যমটির প্রাথমিক উদ্দেশ্যে বিনোদন। কিন্তু জীবনের ছবি? বাস্তবতার ছবি? যেখানে কান্না পাওয়া দেখানো হয়, পুরুষরাও কাঁদেন, ভেঙে পড়া দেখানো হয়, আবেগ ব্যক্ত করতে পিছপা হতে হয় না, যৌনতা দেখানো হয়। সারা ছবিতে নায়ক অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী থাকেন, এটাই জীবন। বাস্তবেও এমনটা হয়। ছবিতে এগুলোও দরকার। ওঁর নিজের কথার সূত্র ধরে বলি, ওঁর ছবিতে পুরো আকাশ দেখা যায় না। ঝলমলে রোদ নয়, জানলার একফালি ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়ে। কিন্তু নয়ের দশকে ওই এক চিলতে রোদই দরকার ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে।
বাংলা ছবি ঘুরতে শুরু করেছে অটোগ্রাফ থেকে, এমনটা আজ বাজার-চলতি প্রবাদ রীতিমতো। আবার কয়েকজন বলেন অঞ্জন দত্তের 'চলো লেট'স গো' থেকে, বাংলা সিনেমা ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা যে ডারউইন-ল্যামার্কদের উপেক্ষা করছি। পরিবর্তন একটা ধারাবাহিক পদ্ধতি, রাতারাতি আসা কোন আগন্তুক নয়। আপনার সন্তান তিতো খেতে চায় না, রোজ অশান্তি করে। কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত তিতো দিতে দিতে তার অভ্যেসে তিতোকে নিয়ে আসতে পারেন, একদিন দেখবেন তিতো সে নিজেই চেয়ে নিচ্ছে। বাংলা ছবির ক্ষেত্রে, সেই তিতো পরিবেশন করার মতোই বাস্তবিক ছবি বাংলার দর্শকদের সামনে বারবার ধরে গিয়েছেন ঋতুপর্ণ। যা দর্শকদের স্বাদ বদল ঘটিয়েছেন, তাই তো এখন শঙ্কর মুদি, জেষ্ঠ্যপুত্র, শব্দ, ইচ্ছে, মুক্তধারা, নগরকীর্তনের মতো ছবি তৈরি করার সাহস দেখায় টলিপাড়া। অভিনেতার ছবি না বলে, ফের পরিচালকের ছবি বলার পুনর্জাগরণ তাঁর আমল থেকেই, ওই তথাকথিত আঁতেলদের ছবিকে পপুলিস্ট ছবিতে রূপান্তরিত করার কান্ডারি ঋতুপর্ণই। তবে বাংলা ছবির উত্তরণের বর্তমান পর্যায় সে দেখে যেতে পারেনি।
কালের মন্দিরা হয়ে ওঁর কাজেরা আজও বেজে চলেছে। আরও কত ছবি হয়ত ওঁর গ্রে সেলে থেকে গেল, দেখানো হল না! দেখাও হল না। সেই আত্মার আক্ষেপও শব্দ করছে। দুই শব্দ মিলে যাচ্ছে, অনুরণনে মিশছে। শব্দ যদি ব্রহ্ম হয়, তবে দুই শব্দের দেখা হচ্ছে, সেখানে অমরত্ব পাচ্ছেন ঋতুপর্ণ।
Powered by Froala Editor