উনিশে এপ্রিল দিনটা কি প্রতি বছর রবিবার পড়ে? অন্তত সেরকমই মনে হত তাঁর। কী হত যদি ‘উনিশে এপ্রিল’ সিনেমাটি তিনি না বানাতেন? পৃথিবীর ক্যালেন্ডার থেকে নিশ্চয়ই একটা দিন খসে পড়ত না। তবুও, বছরের পর বছর দিনটি ফিরে আসে। চলেও যায়। নিজের মতো করেই চলে আসে বিশে এপ্রিল, একুশে এপ্রিল। সময়কে তো আর আটকে রাখা যায় না। শুধু আরেকবার মনে পড়ে তাঁর কথা। ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা।
‘উনিশে এপ্রিল’-কে সিনেমার ধারাপাতে বন্দি করে রাখাটা হয়তো ভুল হবে। জীবনের চলমানতায় সম্পর্কের সমীকরণকে আশ্চর্যভাবে মিলিয়ে নেয় দিনটি। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় ঋতুপর্ণের সঙ্গেও। দ্বিতীয় ছবি হলেও প্রথম মুক্তির আনন্দ ও উত্তেজনায় জমে থাকে কত গল্প।
১৯৯১ সাল। প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’-র কাজ গত বছরই শেষ হয়ে গেছে। সেই এপ্রিলেই ছাড়পত্র দিল সেনসর বোর্ড। কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। পাওয়া যাচ্ছে না পরিবেশক। বাচ্চাদের সিনেমা নিয়ে কেই-বা মাথাব্যথা করে। প্রযোজনা করেছিল বোম্বের একটি সরকারি সংস্থা। বছরে একটি মাত্র সিনেমা বানানো তাদের ‘ডিউটি’। এ বছর বেরিয়ে গেছে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’। ফলে ঋতুপর্ণকে ‘হা ডিস্ট্রিবিউটর, হা ডিস্ট্রিবিউটর’ বলে কলকাতায় জুতোর শুকতলা খসিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। কত স্বপ্ন ছিল ‘হীরের আংটি’ নিয়ে। ছবি মুক্তির পর দেখাবেন সত্যজিৎ রায়কে। পূরণ হল না সেই স্বপ্ন। ১৯৯২-এর এপ্রিলে মারা গেলেন সত্যজিৎ।
ঋতুপর্ণ তখন কাজ করছেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। এক অলস বিকেলে দূরদর্শনে চলছে ‘জলসাঘর’। বহুবার দেখা, তবু প্রত্যেকবারই নতুন মনে হয়। ব্যতিক্রম হল না এবারও। পড়ন্ত বেলায় ‘জলসাঘর’ হয়ে ওঠে একাকী মানুষের গল্প। একটা মানুষ ও নিঃসঙ্গ একটি বাড়ির অন্তরঙ্গতা গোধূলির বিষণ্ণ আলোয় ভরিয়ে দেয় সাদা-কালো টিভির পর্দাকে। ঋতুপর্ণের ভাষায়, “মানুষটি যেন বিগতযৌবনা নর্তকী। আর বাড়িটা যেন তার স্মৃতির জাদুঘর”। এই নিয়েই তো বানানো যেতে পারে একটি ছবি।
আরও পড়ুন
ঋতু-বিসর্জনের উৎসব
পরে অনেকেই বলেছেন, ‘উনিশে এপ্রিল’-এ ইঙ্গমার বার্গম্যান-এর ‘অটাম সোনাটা’-র ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। প্রথমবার চিত্রনাট্য পাঠ করার পর একই কথা মনে হয়েছিল অপর্ণা সেনেরও। কিন্তু ঋতুপর্ণ তখনও ‘অটাম সোনাটা’ দেখেননি। দেখা হয়ে ওঠেনি পরেও। বরং ‘জলসাঘর’-এর বিচ্ছিন্নতা অন্তঃসারে কাজ করেছে ছবিটির মধ্যে। তবু বার্গম্যানের ছায়ার সঙ্গে তুলনা চলেছে আজীবন।
আরও পড়ুন
‘দোসর’ নিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে হাজির ঋতুপর্ণ, ‘বাবার মুখের মতো’ প্রতিক্রিয়া দর্শকদের
পুজো এগিয়ে আসছে। কাজের চাপ বাড়ছে বিজ্ঞাপনের। একদিন এলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘পত্রিকা’-র পুজো সংখ্যার জন্য উপন্যাস লিখতে হবে। শুনে কিছুটা অবাকই হলেন ঋতুপর্ণ। কাজের চাপে বিন্দুমাত্র সময় নেই হাতে, তাছাড়া উপন্যাস লেখার কথা জীবনে ভাবেননি। শেষে ঠিক করলেন একটি চিত্রনাট্য দেবেন। ভেবেচিন্তে নাম দেন— ‘বাৎসরিক’। সিনেমা হলে কজন দেখবে জানেন না, পত্রিকায় বেরোলে তবু কিছু লোক পড়বে। প্রকাশিত হল সেই চিত্রনাট্য। দেখে কিছুটা মন খারাপ হল। তাঁর কল্পনার সরোজিনী-অদিতির সঙ্গে অলংকরণের কোনো মিলই নেই।
লেখা প্রকাশের পর পান ২৫ হাজার টাকার একটি চেক। ‘উনিশে এপ্রিল’ থেকে সেটাই তাঁর প্রথম উপার্জন। ‘বাৎসরিক’ নামে যে সিনেমা চলবে না, এটা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। “পোস্টার থেকে নাকি বাসি মালার গন্ধ পাওয়া যাবে।” তবে উপায়? চিত্রনাট্যে তারিখ দেওয়া ছিল আঠারো এপ্রিল। যেহেতু একটা দিনের গল্প, দিনটাই তো হয়ে উঠতে পারে মূল চরিত্র। পরে ছন্দ মিলিয়ে ঠিক হল ‘উনিশে এপ্রিল’। অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র তবু আপত্তি নামটি নিয়ে। যেন বলশেভিক বিপ্লব নিয়ে ছবি হচ্ছে!
শুরু হল ‘উনিশে এপ্রিল’। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও দেবশ্রী রায় তখন সদ্য বিবাহিত। এর মধ্যে আর বড়ো কাজ ধরেননি। ফলে তাঁদের সময় পাওয়া গেল। মেয়ের বিয়ের পর এলেন অপর্ণা সেনও। বিজ্ঞাপনী সংস্থার অফিস থেকে জিনিসপত্র ধার করে ব্যবহার করা হল। অপর্ণা সেন নিজের পোশাক, ছবি, জিনিসপত্র নিয়ে এলেন সেটে। কোনো পারিশ্রমিক নিলেন না। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও নেননি। দেবশ্রী রায় ও দীপঙ্কর দে নিলেন শুধুমাত্র গাড়িভাড়ার খরচ। ১৯৯৩-এর ২৯ ডিসেম্বর সেনসর বোর্ডের ছাড়পত্র পেল ‘উনিশে এপ্রিল’। ঋতুপর্ণ চাকরি ছাড়লেন ৩১-এ।
ফিরে যাওয়া যাক বেশ কিছুদিন আগের কথায়। তখনও ছবির কাজ শুরু হয়নি। ‘হীরের আংটি’-এর ব্যর্থতা নিয়ে ঘুরছেন তিনি। একদিন রবীন্দ্রসদনে গেছেন একটি নাচের অনুষ্ঠানে। প্রধান অতিথি অপর্ণা সেন। হঠাতই তিনি ঋতুপর্ণকে বললেন, “আচ্ছা, পনেরো লাখ টাকায় একটা ছবি করে দিতে পারবে?” তিরানব্বই সালেও এই বাজেটে সিনেমা তৈরি ছিল বেশ কঠিন। ‘হীরের আংটি’ করতেই লেগেছিল বারো লাখ। আরেকটু বাড়ানো যায় না অঙ্কটা? তার আর প্রয়োজন পড়েনি। পনেরো লাখ ষোলো হাজারে শেষ হয়েছিল ‘উনিশে এপ্রিল’।
জাতীয় পুরস্কার পায় ছবিটি। এক বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে আসে প্রসেনজিৎ-দেবশ্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক। দিন চলে যায় একটি করে। কেটে গেছে তিরিশ বছর। উনিশ-এর পরে আসে কুড়ি, একুশ। পরিবর্তনই তো শেষ কথা। সিনেমার পর্দায়, জীবনে। শুধু অপেক্ষা। পরের বছরের উনিশে এপ্রিলের জন্য...
তথ্যঋণ :
ফার্স্ট পার্সন, ঋতুপর্ণ ঘোষ
Powered by Froala Editor