প্রতি বছরই কালীপুজোতে অমাবস্যার আগের দিন পালিত হয় ভূতচতুর্দশী। এই দিন প্রতিটি বাড়িতে চৌদ্দ পুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে ১৪ শাখ, ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়। অনেক তন্ত্রসাধকের কাছে প্রেতাত্মার সাধনার জন্য এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রাচীন কাল থেকেই গুপ্তবিদ্যাতে বিশারদ এইসব তন্ত্রসাধকরা শবদেহের উপর প্রেত সাধনা করতেন, হয়তো আড়ালে-আবডালে এখনও সেই ধারা অব্যাহত।
উত্তর রাঢ়ের কেতুগ্রাম থানায় কালীপূজা উপলক্ষে পেত্নীর অবয়ব তৈরির একটা চল অনেক অনেক কাল আগে থেকেই চলে আসছে। মূলত খড়, মাটি, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে এই অবয়বগুলোকে বানানো হয় এবং মাথায় ভাঙা হাঁড়ি দিয়ে কাকতাড়ুয়ার মতো মাথাটা তৈরি করা হয়। আমি ছেলেবেলা থেকে এমন পেত্নী মূর্তি বহরান, গঙ্গাটিকুরি, শিবলুন, পাঁচুন্দি, নিরোল কেতুগ্রাম বা অম্বলগ্রামে মতো অনেক জায়গাতেই দেখেছি। দাঁড়ানো বা বসা অবস্থানরত পেত্নী মূর্তিগুলোকে আরও ভয়ার্ত করার জন্য হাড়ির ভেতরে রঙিন আলো ভরে দেওয়া হয়, যাতে অমাবস্যাঘন অন্ধকারে পথচলতি মানুষ আরও ভয় পায়।
ছেলেবেলা থেকেই আমি বিভিন্ন আকৃতির পেত্নী দেখেছি, একবার এখানে এত বড়ো পেত্নী করা হয়েছিল যে পথচারী তো বটেই, গাড়িঘোড়াও তার নিচে দিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে যাচ্ছিল। দশ বছর আগেও গঙ্গাটিকুরিতে প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় বিকটাকার একটা পেত্নীমূর্তি দেখা যেত। এখন গোটা গ্রাম খোঁজ করে একটা বা দুটোর বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। কালীপূজা উপলক্ষে জানি না আর কোথাও এমন পেত্নীমূর্তি বানানো হয় কিনা! তাই আমার একটা মনে একটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করত কালীপূজায় এমন পেত্নী নির্মাণ নিয়ে! ব্যক্তিগতভাবে অনুসন্ধান চালিয়েও তার উত্তর আমি পাইনি। তাতে কয়েকটি সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আমি দেখেছি যে -
ক) প্রাচীন কেতুগ্রাম বা আজকের গঙ্গাটিকুরি ব্লক অঞ্চলে বিশাল বন ছিল, হরিণ-বাঘ-হ্যাড়ল প্রভৃতি প্রাণীতে সমৃদ্ধ ছিল (আজও গঙ্গাটিকুরিতে হরিণডাঙার মাঠ বর্তমান)। এখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করত না, আবার অনতিদূরে অবস্থিত উদ্ধারণপুর ও কেতুগ্রাম মহাশ্মশান দুটো তন্ত্রসাধনার স্থান। এখানে যে প্রেতচর্চার চল বেশ প্রাচীন, তা চোখ বুজে বলা যায়। এখানকার মানুষের অবচেতনে প্রেতিনীচর্চার প্রতি ভয় বা শ্রদ্ধা থেকেও এই পেত্নী নির্মাণ আসতে পারে।
খ) কঙ্কগ্রামভুক্তি, সাল্য গ্রাম ( আজকের সালার), গীতগ্রাম, কেতুগ্রাম অঞ্চল এককালে ছিল বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের অন্তর্গত। এখানে বজ্রযান, তন্ত্রযান, মহাযান মতের প্রচলন ছিল। তন্ত্রসাধনা ও প্রেতচর্চার সুপ্ত ইতিহাসের অঙ্গ হিসাবেও এখানে পেত্নীর তৈরির ধারণা আসতে পারে।
আরও পড়ুন
কালীপুজোর মরশুমে বাজি কেনাবেচা নিষিদ্ধ, নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
কিন্তু যেভাবেই আসুক, সে ধারা আজ লুপ্ত হতে চলেছে। লুপ্ত হতে চলেছে কালীপূজা উপলক্ষে কেতুগ্রাম তথা উত্তর রাঢ়ের আর একটি ধারা 'নেড়াপোড়া'। কালীপূজা এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাটকাঠি, খড় বা তালবাখড়া রোদে শুকিয়ে নেড়াগুলো বানানো হয়। যে নেড়াগুলো কালীপূজার সন্ধ্যায় বা তারপরের দিনের সন্ধ্যাতে পোড়ানো হয়। দোল উপলক্ষে চাঁচর বা নেড়াপোড়া অন্যান্য জায়গায় মতো এখানেও হয়। কিন্তু জানি না কালীপূজা উপলক্ষে অন্য কোথাও নেড়া পোড়ানো হয় কিনা!
এখানে কালীপূজায় নেড়া পোড়ানো কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি সেই সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই তারা দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে, যার একটি হল প্রাকৃতিক কারণ, অন্যটি অর্থনৈতিক কারণ। প্রাকৃতিক কারণ হিসাবে দেখা যায় - শারদ উৎসবের আগে থেকেই পরিবেশে প্রচুর পরিমাণ পোকার আবির্ভাব হয়, যেগুলো সন্ধ্যার পর নাভিশ্বাস করে তোলে মানুষের। দু তিনটি নেড়া একসঙ্গে পোড়ালে প্রচুর পরিমাণে আগুনের শিখা জ্বলে তার উপর উড়ে এসে প্রচুর পোকা মারা যায়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি - সাধারণ গরিব মানুষের হাতে চিরকাল অর্থের কৌলীন্য থাকায় তারা বাজিজাতীয় কিছু কিনতে পারত না কিন্তু আলোর উৎসবে নিজেদের শখ আহ্লাদ মেটাবার বাজির বিকল্প হিসাবে তারা প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি 'নেড়া'কে বেছে নেয়।
আরও পড়ুন
নামাজের পর কালীপুজো – কালাপাহাড়ই মিলিয়ে দিয়েছিলেন দুই সম্প্রদায়কে
আসলে এই কার্তিক মাস এমন একটা মাস, যেখানে আমাদের লোকাচারগুলো আমাদের প্রকৃতির আরও কাছে নিয়ে যায়। তাই আমরা সারা কার্তিক জুড়ে প্রতিটা সন্ধ্যাতে ফানুসের মতো 'ফনা' তৈরি করি বাঁশের কঞ্চির খাঁচাতে রঙিন কাগজ লাগিয়ে তার ভেতরে রোজ প্রদীপ জ্বালিয়ে। যদিও 'ফনাস' দেওয়ার রীতিও লুপ্ত হতে চলেছে, পেত্নী তৈরি বা আজকের ছেলেমেয়েদের নেড়াপোড়া করার মতোই।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শুধু দহনই নয়, কালীপুজোর রাতে ‘রাবণ পোড়া’ উৎসব এঁকে দেয় সারল্যের ছবিও