এ দেশে ছাপা বইয়ের চল শুরু উনিশ শতকে। তার আগে হাতে লেখা পুঁথিই ছিল সাহিত্যের বাহন। কিন্তু, মুদ্রণব্যবস্থা-বিহীন সেই প্রাগাধুনিক যুগে হাতে লেখা পুঁথি জিনিসটা দুর্লভও বটে, দুর্মূল্যও বটে। সবার হাতে হাতে বই তুলে দেবার সুযোগ নেই (সবাই বই পড়তে জানেও না), অথচ বইয়ের বিষয়বস্তু সবাইকে জানাবার, বোঝাবার ইচ্ছে আছে। এই পরিস্থিতিতে উপায় একটাই—বই পড়ে শোনানো। একসঙ্গে অনেককে শোনানোর জন্য চাই জমায়েত, চাই পাঠ বা কথকতার আসর। আর এই আসরকে জমিয়ে তোলার জন্য চাই টানটান গল্প, সেইসঙ্গে সেই গল্পকে সুরে-তালে গেয়ে, বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশন, কখনও বা খানিকটা আঙ্গিক অভিনয়৷ এই সব মিলিয়েই মঙ্গলকাব্য পাঠের আয়োজন৷
"মঙ্গলকাব্যগুলি যেভাবে গান করা হত, সেটা অতিপ্রাচীন লৌকিক ধর্মপ্রচারের একটা রীতি। তার উল্লেখ ঋকসংহিতায় পর্যন্ত পেয়েছি।"—'পত্রং পুষ্পং' বইতে বলেছেন বেদ-বিশেষজ্ঞ শ্রীঅনির্বাণ। সংস্কৃত পুরাণ আর বাংলা পুরাণের মধ্যে জাতিভেদ করতে তিনি অনিচ্ছুক। সংস্কৃত হোক বা অ-সংস্কৃত, জনসমাবেশে ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে পুরাণেতিহাস পাঠের সংস্কৃতি আমাদের দেশে চিরকালীন। যেমন, সাতদিন ব্যাপী ভাগবতপাঠ (সপ্তাহ-পারায়ণ) কিংবা এক মাস ব্যাপী রামচরিতমানস পাঠ (মাস-পারায়ণ)। মনসামঙ্গল পাঠের ক্ষেত্রেও এই পুরাণ-পারায়ণের রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এই কাব্যধারার অন্যতম বিখ্যাত নাম 'পদ্মা পুরাণ'। সুতরাং নিঃসন্দেহে এ আমাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির পুরাণেতিহাস।
মনসাপূজা (Devi Manasha) ও মনসামঙ্গলপাঠের (Manasha Mangal) জন্য নির্দিষ্ট সময় বর্ষাকাল। 'মনসা চরিত' বইতে শঙ্করানন্দ জানিয়েছেন, পূর্ববঙ্গে বর্ষার আগমনে বিস্তীর্ণ ভূমি জলাকীর্ণ, সর্পকুল তখন আশ্রয়ের জন্য মাঠ-ঘাট বন-বাদাড় ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে, সুতরাং সর্পরাজ্ঞীর পূজার উপযুক্ত সময় তো বর্ষাকাল বটেই। এই পূজার অন্যতম অঙ্গ বহুদিনব্যাপী সন্ধ্যাবেলা ধর্মানুষ্ঠানিক মনসামঙ্গল পাঠ। এই পাঠের আয়োজন গ্রামের কোনও বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের বাড়িতে, গায়েন-বায়েন (গায়ক ও বাদক) এর সম্মিলিত উপস্থাপক, এবং শ্রোতা হচ্ছে বর্ষার আগমনে নিশ্চিন্ত ও কর্মবিরতি-প্রাপ্ত কৃষকের দল। শঙ্করানন্দের মতে, প্রাচীন ভারতে বর্ষাকালীন চাতুর্মাস্যের সময়ে ঋষিরা একত্রিত হয়ে অব্রাহ্মণ সূতজাতীয় কথকের মুখে যে পুরাণপাঠ শুনতেন, মনসামঙ্গল ধারায় সেই সংস্কৃতিরই পুনরাবৃত্তি।
বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে দেখা যাচ্ছে, শ্রাবণ মাসের মনসা-পঞ্চমীর রাতে দেবী মনসা স্বয়ং কবিকে স্বপ্নাদেশ দিচ্ছেন তাঁর মহিমাসূচক কাব্য-রচনার জন্য। নিজের লীলাবৃত্তান্তের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে তিনি কবিকে বলছেন—
আরও পড়ুন
নিছক লৌকিক দেবী নন, ষষ্ঠীর কথা রয়েছে শাস্ত্রেও
কহিলাম সকল কথা যে জানি বৃত্তান্ত।
গীত নহে এ জানিও মনসার মন্ত্র।।
যথা গীত শুনি আমি তোমার রচিত।
সত্য করি কহি তথা যাইব নিশ্চিত।।
আরও পড়ুন
বোলপুরে 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' লিখলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ, ডাইরির সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই কাব্যও
অ-সংস্কৃত ভাষার দেবোপাসনা-মন্ত্র ভারতীয় সংস্কৃতিতে শাবর মন্ত্র নামে পরিচিত। মনসামঙ্গল যে সাধারণ সাহিত্য নয়, মন্ত্র-মালা—এই বিশ্বাসের কথা বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে পেলাম স্বয়ং মনসার জবানিতে। এও পাচ্ছি—এই কাব্য গায়নকালে স্বয়ং মনসা আসরে উপস্থিত থাকবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। অর্থাৎ এই আসরে শ্রোতা কেবল মানুষ নয়, সপার্ষদ মনসাও শ্রোতা। তাই কাব্যের শুরুতেই ঘটস্থাপন বিধির মাধ্যমে পারিষদ-বর্গসহ আসরে অবতীর্ণ হবার জন্য কবি-কর্তৃক মনসার আবাহন লক্ষণীয়।
শঙ্করানন্দ 'মনসা চরিত' বইতে বলছেন, পূর্ববঙ্গে কোনো বর্ধিষ্ণু গৃহস্থের বাড়িতে মনসামঙ্গল পাঠের আসর শুরু হত বায়েনের মৃদঙ্গ বা ঢোলক বাজানোর মাধ্যমে। এ হল সারা গ্রামকে সচেতন করে তোলার সঙ্কেত—পাঠ এবার শুরু হবে। তারপর গৌরচন্দ্রিকা, তারপর দিশা। দিশা কী? দিশা হলো সেদিনের পাঠ্য বিষয়ের দিক্ নির্ণয় বা আভাস, এখনকার ভাষায় বলা যেতে পারে 'ট্রেলার' জাতীয় ব্যাপার। নারায়ণ দেবের পদ্মাপুরাণে এইসমস্ত দিশা দেওয়া আছে, সেগুলি গাওয়া হতো। আবার অনেক শক্তিমান গায়েন নিজেই দিশা রচনা করে গাইতেন৷ এই যেমন—"দীনহীন কাতরে ডাকে মা তোরে। চরণছায়া দে গো আমারে।।" ইত্যাদি। দিশার পর কিছুক্ষণ ঝুমুর গান, তারপর পয়ার-ত্রিপদী-লাচাড়ি ইত্যাদি ছন্দে মূল কাব্যপাঠ। এই পাঠ শুরু হতো জ্যৈষ্ঠ মাসের নাগপঞ্চমীতে, শেষ হত দীর্ঘ কয়েক মাস পরে ভাদ্র মাসের পয়লাতারিখ৷ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এই আনন্দের ভাগ থেকে কেউই বাদ পড়ত না।
মনসা-কাহিনি কথনের আরেকটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন বাংলার পটুয়া সম্প্রদায়। হাতে আঁকা জড়ানো পটে মনসা-কাহিনির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এঁকে রাখেন তাঁরা, তারপর মানুষজনের জমায়েতে দাঁড়িয়ে, আস্তে আস্তে পটের পরত খুলতে খুলতে গান করেন মনসার আখ্যান। ফলে, এই উপস্থাপন একইসঙ্গে দৃশ্য ও শ্রাব্য হয়ে ওঠে। এই কথনরীতিতে সম্পূর্ণ কাব্য নয়, কাব্যের একটি কাহিনীসার অল্প সময়ের মধ্যে পড়া হয়। মেলা-জাতীয় জমায়েতে এমন উপস্থাপন সাধারণত পটুয়া-পরিবারের মেয়েরা করে থাকেন। এঁদের বলা চলে ভ্রাম্যমাণ কথক।
মনসামঙ্গল পাঠ ও শ্রবণের ফল কী? আর এই কথকতায় অবহেলার ফলই বা কী? এ ব্যাপারে, বিজয় গুপ্তের কাব্যের শুরুতে রয়েছে মনসার উক্তি—
মোর গীত শুনি যার হৃদয় কৌতুক।
মোর বরে হবে তার মহাধন সুখ।।
অহঙ্কারে মোর গীত করে উপহাস।
মোর কোপে হইবে তার সবংশে বিনাশ।।
যাহার ঘরে গায় গীত আমার স্তবন।
পাতিয়া উত্তম ঘট বিচিত্র আসন।।
জয় জয় হুলাহুলি দিয়া বলিদান।
মোর বরে হবে তার সর্বত্র কল্যাণ।।
অপুত্রার পুত্র হবে নির্ধনের ধন।
রোগীর রোগ দূর হয় বন্দী বিমোচন।।
নারী যার ঘরে নাহি নারী হয় ঘরে।
মনের অভীষ্ট সিদ্ধ হয় মম বরে।।
লক্ষ্য করবেন, এই ফলাফল-তালিকার মধ্যে যা যা প্রতিশ্রুতি, তার সবই ইহলৌকিক। পুত্রলাভ, ধনলাভ, রোগমুক্তি, বন্দিদশা থেকে মুক্তি, পত্নীলাভ ইত্যাদি সবই একান্তভাবে বর্তমান জীবনের প্রয়োজন, এবং আরও বিশেষায়িত করলে, গার্হস্থ্য বা পারিবারিক জীবনের প্রয়োজন। এছাড়া সর্পভয় থেকে মুক্তির আশ্বাস তো মনসা-আরাধনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বটেই।
তবে, পারলৌকিক কল্যাণের কথা কি মনসামঙ্গলকারেরা একেবারেই ভাবেননি? ভেবেছেন। তাই কখনো কাব্যের মধ্যে ধুয়া আকারে, আবার কখনো কাব্যের সমাপ্তিতে তাঁরা এনেছেন হরিনাম-প্রসঙ্গ, কারণ শ্রীচৈতন্য-প্রভাস্বর বাংলার জনচেতনায় সর্বস্তরের মানুষের সহজ সাধনোপায় এই হরিনাম। বিজয় গুপ্তের কাব্যের অন্তিমে কবির নির্দেশ "মনসা আনন্দে সবে বল হরি হরি।" বিপ্রদাস পিপিলাই কাব্যের শেষে বলছেন, "হরি বলি সর্বজন চল নিজ পুরে।" কেতকাদাস ক্ষেমানন্দেরও অন্তিম বক্তব্য—"মঙ্গল হইল সাঙ্গ বল হরি হরি।"
নগরাঞ্চলে কথকতার ধারা এখন লুপ্তপ্রায়। কিন্তু তাও, দুই বাংলার বিশেষ কিছু অংশে এখনও বহমান পল্লীসমাজের এই ঐতিহ্য। এ ধারা হয়তো বা ক্ষীণস্রোতা, কিন্তু অদৃশ্য নয়। শ্রাবণ এলে গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে সে-জন্যেই বসে মনসামঙ্গল পাঠের আসর। বাঙালিও, ফিরে পায় তার সহস্রাব্দ-প্রাচীন ঐতিহ্যকে।
Powered by Froala Editor