আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগের কথা। অবলুপ্তির কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল আফ্রিকার (Africa) সাউদার্ন সাদা গণ্ডাররা। তৎকালীন সময়ের নথি বলছে গোটা আফ্রিকায় সে-সময় অবশিষ্ট ছিল মাত্র ১০০টি সাউদার্ন সাদা গণ্ডার (Southern White Rhino)। তাদের বিলুপ্তির মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে ১৮৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বুকে গড়ে তোলা হয়েছিল এক বিশেষ সংরক্ষিত অরণ্য, লুহলুয়ে-ইমফোলোজি পার্ক (Hluhluwe-Imfolozi Park)। পরবর্তীতে যা ভাগ্য বদলে দেয় বিপন্নপ্রায় প্রজাতিটির। আজ নামিবিয়া, জিম্বাবয়ে, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক বা জাম্বিয়াতে যে সাদা গণ্ডার দেখতে পাওয়া যায়, তা আদতে সরবরাহ করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার এই অরণ্য থেকেই। অথচ, ১২৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার চোরাশিকারিদের তাণ্ডবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার এই সংরক্ষিত অরণ্যের ভাগ্য।
হ্যাঁ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাচীনতম ও সবচেয়ে সুরক্ষিত অরণ্যেই এখন অসহায় গণ্ডাররা। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসেই, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ১৯০টি গণ্ডার শিকার হয়েছে চোরাশিকারিদের (Poachers)। বলতে গেলে, এই অরণ্যে প্রতি ৩৫ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছে একটি করে গণ্ডার। শুধু লুহলুয়ে-ইমফোলোজিই নয়, চলতি বছরে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়েই গণ্ডার শিকারের মাত্রা ছুঁয়েছে নতুন রেকর্ড। দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে শিকারের হার। কিন্তু আকস্মিক এমন ঘটনার কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই ঘটনার পিছনে স্পষ্ট হাত রয়েছে মহামারী ও লকডাউনের। লকডাউনের কারণে বিগত দু’বছর বন্ধ ছিল চোরাশিকার। সেই ঘাটতি পূরণ করতেই নির্বিচারে গণ্ডার শিকার করে চলেছেন অবৈধ ব্যবসায়ীরা। তাছাড়াও রয়েছে আরও একটি কারণ। বিগত পাঁচ দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার লুহলুয়ে-ইমফোলোজি পার্কই ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত অরণ্য। এমনকি সাদা গণ্ডারের সবচেয়ে বড়ো আবাসস্থল হওয়া সত্ত্বেও এতদিন শিকার সেখানে হত না বললেই চলে। অন্যদিকে বিগত এক দশক ধরেই নির্বিচারে গণ্ডার নিধন চলছে ইমফোলোজি পার্কের নিকটবর্তী ক্রুগার জাতীয় উদ্যানে। ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ গণ্ডার হারিয়েছে এই জাতীয় উদ্যানটি। এই জাতীয় উদ্যানে চোরাশিকারিদের তাণ্ডব কমাতে সম্প্রতি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রশাসন। মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। তাই ব্যবসা বাঁচাতে ইমফোলোজিতে আশ্রয় নিয়েছেন চোরাশিকারিরা।
তবে আশঙ্কার বিষয় হল, বিপুল নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেও ইমফোলোজির পরিস্থিতি একদিনে বদলানো সম্ভব নয়। আর তার কারণ, এই অরণ্যের আকার। ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের চেয়ে আয়তনে প্রায় ২০ গুণ বড়ো ইমফোলোজি। কাজেই নজরদারি সত্ত্বেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে শিকারিরা। তবে কি কোনো উপায়ই নেই এই হত্যাযোগ্য থামানোর?
বছর দুয়েক আগে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর কেড়েছিল আফ্রিকার এক আশ্চর্য দৃশ্য। কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া, নামিবিয়া-সহ একাধিক আফ্রিকান দেশে কেটে ফেলা হয়েছিল গণ্ডারের শৃঙ্গ। হ্যাঁ, বনদপ্তরের কর্মীরাই এই কাজ করেছিলেন চোরাশিকার ঠেকাতে। দক্ষিণ আফ্রিকার ছবিও ছিল একইরকম। শুধু ব্যতিক্রম হিসাবে লুহলুয়ে-ইমফোলোজি পার্ক কর্তৃপক্ষ সে-পথে হাঁটেনি। চোরাচালানের সিন্ডিকেট ঠেকাতে নিরুপায় হয়েই এবার ডিহর্নিং-এর ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং গবেষকরা। সেই সঙ্গে দেশের বেকারত্বের সমাধান করার জন্যেও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষ। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে, এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব নয় বলেই দাবি তাঁদের…
Powered by Froala Editor