১৯০৭ সাল। বঙ্গভঙ্গের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। লর্ড কার্জন তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়; এদিকে বাংলার মানুষদের মধ্যেও জেগে উঠেছে বিপ্লবী চেতনা। গঙ্গা, পদ্মার দুই পাড়েই নেমে এলেন বিপ্লবীরা। কিন্তু সবাই কি বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিল? এই প্রশ্ন উঠে এসেছিল ঢাকার এক যুবকের মনেও। সেদিন বাড়িতে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন; সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন বিপ্লবী সঙ্গী। হঠাৎই বাড়ির সামনে চিৎকার। কয়েকশো মানুষ ঘিরে ফেলেছে তাঁদের, প্রত্যেকেই মারমুখী। নাগালে পেলেই ছিন্নভিন্ন করে দেবে। কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্যও তো স্বাধীনতার লড়াই! এখন এঁদেরকে প্রতিহত করতে হবে। মাত্র কয়েকজন সঙ্গী; তাঁদের নিয়েই ওই উদ্যত কয়েকশো মানুষকে সামলালেন বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস। হাতের কবজি শক্ত হয়ে উঠল লাঠির জোরে…
অবিভক্ত বাংলা তখন বিপ্লবের রঙ্গমঞ্চ। নরম নীতি নয়; বন্দুকের বদলা বন্দুকই— এমনটাই বিশ্বাস তরুণদের। বঙ্গভঙ্গের পর যেন এই বিশ্বাস বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল। সামনে থেকে লড়াই করেই ছিনিয়ে আনতে হবে স্বাধীনতা। পুলিনবিহারী দাসও এমনটা মনে করতেন। জন্মেছিলেন ১৮৭৭ সালে। ঠিক ২০ বছর আগে পেরিয়ে গেছে সিপাহী বিদ্রোহ। স্বাধীনতার আন্দোলন যেন অন্য দিগন্তে পৌঁছে গেছে। কংগ্রেস দলও সামনে চলে আসবে বছর কয়েক পর। আর এমন আবহেই আগমন পুলিনবিহারীর।
দাস পরিবারের অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। পুলিনবিহারীর বাবা ছিলেন মাদারিপুর মহকুমার উকিল। তাঁর আত্মীয়রাও ছিলেন যথেষ্ট উচ্চপদস্থ। তাঁদেরও আশা ছিল, পড়াশোনা করে পুলিনও চাকরি-বাকরি করবে। কিন্তু তেমনটা হল না। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালোই ছিলেন তিনি। ফরিদপুর জেলা স্কুল, ঢাকা কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু মনটা যে পড়ে আছে অন্য জায়গায়। চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশরা, দেশের মানুষের ওপর চলছে জুলুমরাজ। আর পুলিনবিহারী চুপ করে থাকবেন?
তবে কেবল পড়াশোনাই নয়, ছোটো থেকে আরও একটি বিষয় নিয়ে চর্চা ছিল তাঁর। শরীরচর্চা এবং লাঠিখেলা। বাঙালি ছেলেরা নাকি দুর্বল; সেজন্য সেনাবাহিনীতেও নাকি জায়গা পান না তাঁরা। আর শরীর দুর্বল মানে মনও অনেকক্ষেত্রে ঝিমিয়ে পড়ে। সেরকম মানুষ একেবারেই ছিলেন না পুলিনবিহারী দাস। একেবারে ছোটো বয়স থেকেই ব্যায়াম করতেন তিনি। বড়ো হলে শরীরচর্চার সঙ্গে এসে জুটল লাঠিও। তেল মাখানো মোটা, শক্ত লাঠি নিয়ে কেরামতি দেখাতেন; পেশিও শক্ত হয়ে উঠত। যত দিন গেল, পুলিনবিহারীও অনুভব করলেন এই শক্ত পেশিরই এখন দরকার সবার। অন্তত ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে শরীর ও মনের উপযুক্ত গঠন ছাড়া উপায় নেই…
এমন সময় নেমে এল বঙ্গভঙ্গ। বাংলার শিরদাঁড়া যেন নড়ে উঠল এই একটি আঘাতে। পুলিনবিহারী দাস তখন ঢাকাতে শুরু করেছেন নিজস্ব আখড়া। এরই মধ্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় উপস্থিত হলেন প্রমথনাথ মিত্র এবং বিপিনচন্দ্র পাল। ততদিনে কলকাতায় তৈরি হয়ে গেছে অনুশীলন সমিতি। পরবর্তীকালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ ময়দান হতে চলেছে এই সংগঠন। কিন্তু কেবল কলকাতায় আটকে রাখলেই কি আর হবে সবটা? শহরের গণ্ডি ছেড়ে বাংলার অন্যত্রও তো যেতে হবে। সেইসূত্রে চলে আসা ঢাকায়। প্রমথনাথ এবং বিপিনচন্দ্র চেয়েছিলেন, এমন কোনো মানুষ দায়িত্ব নিক যার সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, নিষ্ঠা আর চেতনা বাকি তরুণদেরও উদ্বুদ্ধ করবে। তখনই তাঁদের চোখ পড়ল পুলিনবিহারী দাসের ওপর। পেটানো চেহারার যুবকটি যেন মূর্তিমান সাহস। ১৯০৬ সালেই অক্টোবর মাসে পুলিনবিহারীর নেতৃত্বে জড়ো হল অন্তত ৮০ জন যুবক। তৈরি হল ঐতিহাসিক ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’।
এই একটি জায়গাতেই আটকে রইলেন না তিনি। পুলিনবিহারীকে দেখে আরও যুবক আসতে লাগল অনুশীলন সমিতিতে। শরীরচর্চা থেকে শুরু করে অস্ত্র চালনা, বন্দুক চালানো সমস্ত কিছুই শেখানো হল সবাইকে। সেইসঙ্গে দীক্ষা দেওয়া হল দেশপ্রেমের। আক্রমণই ব্রিটিশদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবে; এবং তাঁদের ভয় পাওয়াটা দরকার। দেখুক, ‘দুর্বল’ বাঙালিরা কীভাবে চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারে। শুরু হল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড।
আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন বিপ্লবী উধম সিং
এই সময় বেশ কিছু কাজ করলেন পুলিনবিহারী দাস। প্রথমত, শরীরচর্চার পাশাপাশি অস্ত্রচর্চাও যে বিপ্লবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই ভাবনাটা সবার মধ্যে ছড়াতে চাইছিলেন। তবে অস্ত্রের নাম জানলেই তো হবে না; তার সম্পর্কে একটু জ্ঞানও তো থাকা প্রয়োজন। সেজন্যই তিনি শুরু করলেন অস্ত্র নিয়ে গবেষণা। সেই বিস্তীর্ণ কাজ নিয়ে প্রকাশ করলেন বই - ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’। ওই সময় দাঁড়িয়ে আর কোনো ভারতীয় এমন কাজটি করেছেন কিনা জানা যায় না। সেইসঙ্গে জারি ছিল বিপ্লবী কাজও। জমিদার-ধনীদের বাড়িতে ডাকাতি থেকে উচ্চপদস্থ ইংরেজদের টার্গেট করা— তিনিই যেন নেতা। ঢাকার তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ওপরও আক্রমণ করেন পুলিনবিহারী। কিন্তু একটুর জন্য বেঁচে যান ওই সাহেব। ফলস্বরূপ, ১৯০৮ সালে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে পুলিনবিহারী দাসের গ্রেফতার ও আন্দামানে দ্বীপান্তর।
যতদিন বেঁচেছিলেন, যুবসমাজকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য থেকে সরে যাননি তিনি। আন্দামান থেকে ফিরে এলে তৈরি করেন বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি। উদ্দেশ্য তখনও একটিই। ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’। শুধু শরীরের শক্তিই নয়; মনের বিকাশও জরুরি। আর তার জন্য স্বামীজির পন্থাই ছিল অন্যতম পথ। যারা পুলিনবিহারী দাসের কাছে আসতেন, প্রত্যেককেই তিনি স্বামীজির মন্ত্রে দীক্ষিত করতেন। সব দিক থেকে না জাগলে যে কিছুই হবে না! শুধু ব্রিটিশ বলে নয়, নিজেদের জন্যও তো বাঁচতে হবে! সেই মানুষটিই আজকের বাঙালির কাছে কতটা পরিচিত? সে উত্তর আপনারাই দেবেন না হয়…
তথ্যসূত্র-
১) ‘লাঠিখেলা থেকে বুড়িবালাম: মহানগরে দুই বিপ্লবীকে স্মরণ’, এই সময়
২) ‘বঙ্গের অঙ্গশক্তি লাঠিখেলা’, দুর্গেশ তেজস্বিনী, বঙ্গদেশ
আরও পড়ুন
তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন খোদ টলস্টয়ের বিপক্ষে, বিস্মৃতির অতলে বিপ্লবী তারকনাথ দাস
Powered by Froala Editor