একেকটা নতুন বছর আসে একেকটা স্বপ্ন নিয়ে। নতুন আশা, নতুন করে শুরু করার শপথ। ভারতের কাছে প্রতিবছর নিয়ম করে অন্তত দুদিন ফিরে দেখা পরাধীনতার ইতিহাসকে। মনে করা সেই মানুষদের, যাঁদের আত্মত্যাগের জন্য আজ খোলা নীল আকাশে ঝকমকিয়ে ওঠে ত্রিবর্ণ পতাকা। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এমনই বহু স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবস প্রত্যক্ষ করেছিলেন এক বৃদ্ধা। পুরুলিয়ায় আরও বহু মানুষের মতোই; একাকী, নিঃসঙ্গ হয়ে। কিন্তু এভাবে নিরালায় থাকার তো কথা ছিল না লাবণ্যপ্রভা ঘোষের। এই স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনিও যে একজন শরিক। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পুরুলিয়ায় আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন। আজ তিনি নেই। অবশ্য, থেকেও কি ছিলেন?
গোটা পুরুলিয়া তাঁকে জানত ‘মানভূম জননী’ বলে। নিজের কাজকে সমাজের সমস্ত জায়গায় নিয়ে গেছেন। সেই শিক্ষা তো পেয়েছিলেন ছোটোবেলাতেই। আক্ষেপ, তাঁর কিশোরী জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে পুরুলিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন ছোট্ট লাবণ্য। দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট, ১৮৯৭। স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি পুরুলিয়া জিলা স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন নিবারণবাবু। ছোটোবেলা থেকে কোনোদিন স্কুলে যেতে পারেননি লাবণ্যদেবী। যে সময়টায় জন্মেছিলেন, তখন মেয়েদের স্বাধীনতা, শিক্ষা নিয়ে খোদ কলকাতাতেও নানা সংগ্রাম করতে হত। পুরুলিয়া তো আরও দূরের কথা। স্কুলে না গেলে কী হবে, মেয়েকে নিজের মতো করে প্রাথমিক শিক্ষাটুকু দিয়েছিলেন নিবারণবাবু। তাঁর কাছেই বেড়ে উঠছিলেন লাবণ্য। তৈরি হচ্ছিল রাজনৈতিক চেতনা, স্বাধীনতার মন্ত্র।
বয়স তখন মাত্র ১১। বাকি পাঁচটা মেয়ের মতোই বিয়ে হয়ে গেল লাবণ্যপ্রভার। পাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষ। বয়সে ষোলো বছরের বড়ো; ইনি নিজেও সেই সময়ের পুরুলিয়ার প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাই ভিটে বদল হলেও, মূল জমিটি অটুট থাকল। বলা ভালো, তা আরও পোক্ত হল। পুরুলিয়া অনেক অতুলচন্দ্র আর নিবারণচন্দ্রের অনেক পরিকল্পনা। এরই মধ্যে ১৯২১ সালে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করার জন্য গ্রেফতার হন নিবারণবাবু। কিন্তু এত সহজে কি সব থেমে যায়? একবার গ্রেফতার করলেই কি ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যাবে সব? দ্বিগুণ গতিতে ভাবনাচিন্তা চলতে লাগল। এবার যোগ দিলেন লাবণ্যপ্রভাও। জেল থেকে বেরনোর পর ঠিক হল পুরুলিয়ায় একটা আশ্রম তৈরি করা হবে। সেই শুরু ‘শিল্পাশ্রম’-এর পথ চলা। নিবারণ দাশগুপ্ত ও অতুলচন্দ্র ঘোষের মিলিত উদ্যোগে পুরুলিয়ার তেলকলপাড়ায় স্থাপিত হল আশ্রম। বিপ্লবী ও নেতাদের ঘাঁটি তো হলই; সেইসঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম কার্যালয় হিসেবেও সবটা চলতে লাগল।
একটা সময় কে না আসেননি এখানে? মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ বহু জাতীয় নেতাদের আনাগোনা ছিল শিল্পাশ্রমে। ধীরে ধীরে এবার আন্দোলনের মূল স্রোতেও ঢুকে পড়লেন লাবণ্যপ্রভা। শুধু সংগ্রামই নয়, স্থানীয় মানুষদের উন্নয়নের দিকেও খেয়াল ছিল তাঁর। যেদিকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নজর দিয়ে এসেছেন। মানুষের জন্য কাজ করতে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই, বিরাম নেই। ঠিক তেমনই বিরাম নেই দেশের হয়ে কাজ করারও। তার জন্য ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতারও করেছে তাঁকে। একবার নয়, বহুবার। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। অতুল ঘোষের সঙ্গে নিজেও কাজ করতে লাগলেন। ১৯২৬ সালে মানভূম জেলার কংগ্রেস কমিটির সদস্য হলেন লাবণ্য। তার চারবছর পরেই শুরু হল গান্ধীজির বিখ্যাত ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। দেশের নানা জায়গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগেও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হল সেই সময়। এবার হাল ধরলেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। পুরুলিয়াতেই লবণ সত্যাগ্রহের আন্দোলন ও মিছিলের আয়োজন করলেন তিনি। একইভাবে ১৯৪৫ সালে কোনাপাড়ার ‘পতাকা সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ, আবার কারাবাস…
অবশ্য এটুকুই ভূমিকা ছিল না তাঁর। ১৯২৫ সালে নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। নাম দেন ‘মুক্তি’। স্বাধীনতা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস দেখতে গেলে, এই পত্রিকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নিবারণচন্দ্রের পর তাঁর জামাতা অতুল ঘোষ নিজে এঁর দায়িত্ব নেন। এখানেই নানা বিষয় নিয়ে লিখতে আরম্ভ করেন লাবণ্য। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সাল থেকে স্বামীর মৃত্যুর পর যখন নিজে পুরো দায়িত্বটা নিয়ে নেন, শেষ দিন পর্যন্ত সেই কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। সমাজের কথা, মানুষের কথা, বঞ্চনা আর অত্যাচারের কথা উঠে আসত সেই পত্রিকায়। অন্যায় হলেই গর্জে উঠেছে ‘মুক্তি’। মানুষই হবে শেষ কথা…
দীর্ঘ আন্দোলনের ফল এল ১৯৪৭-এ। প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অবশেষে হাজির হল দেশে। কাঁটাতারে দীর্ণ, রক্তাক্ত; তবুও এই স্বাধীনতা মেনে নিয়েছি সবাই। কিন্তু পরিস্থিতি যে শান্ত হয়েছে এমন ভাবাটা ভুল। অতুল-লাবণ্যও তেমনটাই দেখলেন নিজের অঞ্চলে। পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চল এতদিন বেশ ভালোই ছিল। বাঙালি, আদিবাসী সবাই একসঙ্গে বেড়ে উঠছিল নিজেদের মতো করেই। হঠাৎ করে সেখানে অদৃশ্য চোখরাঙানি দেখতে আরম্ভ করেন লাবণ্য। জোর করে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দি ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এটা কিছুতেই মানতে পারলেন না লাবণ্যদেবী। বাংলা ভাষাতেই তাঁরা কথা বলে আসছেন এতদিন। এখন সরকার যদি চাপ দিয়ে অন্য কোনো ভাষা চাপিয়ে দেয়, সেটা কেন মানবেন? সেখান থেকেই পুরুলিয়া ও মানভূম অঞ্চলে শুরু হল আরেক ভাষা আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর আন্দোলন। যার একদম সামনের সারিতে রইলেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। বিহার সরকার তিন তিনবার তাঁকে জেলবন্দি করল। কিন্তু আন্দোলন থামেনি। এবারও আগুন ঝরল ‘মুক্তি’র পাতায়। শেষ পর্যন্ত তাঁদের দাবি মানা হল। ১৯৫৬ সালে বিহার থেকে আলাদা হয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ল পুরুলিয়া। লাবণ্যদেবী হয়ে উঠলেন ‘মানভূম জননী’!
আরও পড়ুন
স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান, বিস্মৃতির অতলে নীলিমা ঘোষ
এর পরের অধ্যায়টা খুবই সীমিত। ঘটনা বলতে দুটি; ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার সময় আবার গ্রেফতার হওয়া এবং বিধায়ক হিসেবে মনোনীত হওয়া। বাকি জীবনটা বিস্মৃতি আর দারিদ্র্যের। শিল্পাশ্রমের ঘরটিতেই থাকতেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। সঙ্গে ছিল তিন সন্তান। ১০৬টি বছর কাটিয়েছিলেন জীবনের। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীর সামান্য পেনশনটুকু ছাড়া আর কি কিছু পেলেন? তাঁর বাংলার মানুষদের কাছেই একপ্রকার ব্রাত্য থেকে গেলেন। কোথাও কোনো মূর্তি বসেনি, তাঁর নামটিও মনে রাখেনি কেউ। কিন্তু লাবণ্যদেবী মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাননি কোনদিন। শেষের দিন পর্যন্ত ব্রত ছিল একটাই— মানবসেবা। আর মানুষের ওপর তো কখনও বিশ্বাস হারাতে নেই! বলেই গিয়েছিলেন একজন…
Powered by Froala Editor