নাজিম হিকমত বলেছিলেন, 'আধুনিক বিশ্বের কবিতা দুধরনের। এক, প্রতিবাদী কবিতা। দুই, যে কবিতা নিজেই প্রতিবাদ।' বাংলার যে ক'জন আধুনিক কবির কবিতা নিজেই প্রতিবাদ হয়ে উঠেছে, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৫)। তরুণ বয়সের সৌখিন কাব্যরচনার প্রাথমিক বিলাসিতা ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি লিখতে শুরু করেন 'যে লেখা ছিল প্রয়োজন।' অল্পবয়সে লেখা 'তোমার চোখে চোখ রেখে'-র মতো কবিতা নিয়ে নিজের অস্বস্তি লুকোননি বীরেন্দ্র, বরং বলেছেন ওই লেখাদের 'দায় এখন পর্যন্ত বহন করার মতো শক্ত কাঁধ আমার নেই।' কেননা, ততদিনে বদলে যেতে শুরু করেছে তাঁর কবিতা লেখার উদ্দেশ্য, কাব্যের ভাষা। কবি নিজেই যেন নিজেকে বলছেন : 'লিখতে হয় লিখবি কবিতা/কিন্তু যদি সত্যিকারের ভালোবাসিস জন্মভূমির মানুষ,/তাহলে তার জন্য আগে কাপড় বোন, আগুনে সেঁক রুটি।' আরেক জায়গায় বলছেন, 'তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,/তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।'
কবির কথা শুনে মনে হতে পারে, তাঁর কাছে এই হন্যমান, ক্ষুৎকাতর, মহাজাগতিক মৃত্যুতমসার মধ্যে অবস্থান করে কবিতা লেখা বা পড়া বিলাসিতার সমান। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে তিনি নিজে কেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা লিখলেন? কবি নিজে বলেছেন, 'আমি আর কোনও কাজের যোগ্য নই, সেইজন্য আমি কবিতা লিখি।' কিন্তু তাঁর এই বিনয়ী মন্তব্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। আসলে 'কবিতা' কথাটা বললেই যে রোম্যান্টিক, দৃশ্যসুন্দর, প্রেমময়, পেলব ছবি আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতাকে সেই ছবির অর্গল থেকে বের করে আনতে চেয়েছেন। তার বদলে লিখতে চেয়েছেন এবং লিখতে পেরেছেন 'অবাধ্য কবিতা', যে কবিতা কোনো প্রথা মানবে না, প্রতিষ্ঠান মানবে না।
চিরকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধী আপসহীন বীরেন্দ্র লিখেছিলেন : 'মাথা উঁচু রাখতে হয়, নরকেও।' তাই যারা মাথা উঁচু রাখতে পারে না, আপোস যাদের রোজনামচার প্রত্যঙ্গ, তাদের সঙ্গে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আজীবনের শত্রুতা। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার এই অনড় প্রবণতাটির কারণে অনেকসময় বৌদ্ধিক পরিসরে অবস্থান করা অনেক সমসাময়িকেরও বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি। একবার কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর তীব্র সমালোচনা করে বীরেন্দ্র লেখেন, 'পোশাক ছাড়া নীরেন, আমরা/সবাই যে ন্যাংটো.../কিন্তু তুমি বুঝবে কি আর/তোমার যে ভাই, মাইনে বেড়েছে।'
অকুতোভয়, বেপরোয়া বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাকে অনেকেই 'অলংকারহীন' বলে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য, প্রতিবাদের আলোয় কাব্যের নান্দনিকতাকে বলি দিয়েছেন বীরেন্দ্র। বোধহয় তারা বুঝতে পারেননি বা 'কেউ তাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়নি', ওঁর কবিতায় প্রতিবাদ নিজেই পরম নান্দনিকতায় ঋদ্ধ। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় শব্দের চেয়ে বেশি আছে আর্তনাদ; তাঁর কবিতায় এমন এক রিক্ত ভুবনকে আমরা পাই যেখানে শুধুই ক্ষুধা, চিৎকার, আতঙ্ক, কান্না আর প্রলয়ের সহাবস্থান। রিলকে বলেছিলেন, 'একমাত্র তা-ই থেকে যাবে যা রক্ত দিয়ে লেখা।' বীরেন্দ্র-র লেখা থেকে গেছে, যাবেও, কারণ তিনি লিখেছেন রক্ত দিয়ে : 'শীতের মতই রক্ত মিশে আছে কবিতায়/মৃত্যুর মতই রক্ত মিশে আছে কবিতায়।'
আরও পড়ুন
হেলেন কেলারের হাতে আঙুল চালিয়ে কবিতা ‘পড়ালেন’ রবীন্দ্রনাথ
রবার্ট ফ্রস্ট লিখেছিলেন, 'প্রকৃত কবি হ'ল আমাদের কান।' কথাটা ঠিকই, তবে বীরেন্দ্র-র কান কোনো পেলব, মধুর সঙ্গীত শুনতে পায়নি, কারণ যেদিকেই তিনি কান পেতেছেন, শুনেছেন শুধু 'শিশুর কান্নার স্বর', তাই লিখেছেন : 'একটি শিশু পায়রাকে সে/বুকের ভেতর আগলে রাখে/বাইরে ওড়ে শিকারি বাজ/আবার কখন কুকুর ডাকে।' 'দেশ বলতে' কবিতায় লিখছেন 'বাইরে শুধু ভূতের ভয়/ঘরে ঢুকলে খিদে/পেটের মধ্যে সাত সমুদ্দর/কেবল বলে দে।'
আরও পড়ুন
কবিতা থেকে সিনেমা - সর্বত্রই নতুন ভাষা খুঁজেছেন বুদ্ধদেব
জয়দেব বসু বলেছিলেন, 'বীরেন চট্টোপাধ্যায় একটা স্পিরিট, তাঁকে ঠেকানো যাবে না।' ঠেকানো যে যাবে না, তা বোধহয় কমবেশি সকলেই বুঝতেন। তাই প্রায়ই তথাকথিত সুধীজনদের আয়োজিত নানাবিধ কবিতাপাঠের আসরে বীরেন্দ্র ছিলেন ব্রাত্য। কোনো গোষ্ঠী, কোনো দল, কারোর সঙ্গেই স্থায়ী সখ্য গড়ে ওঠেনি 'কবি' বীরেন্দ্র-র। কোথাও কখনও যদিওবা তিনি ডাক পেলেন, সেই কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজকরা তাঁকে পরের বার থেকে আর ডাকলেন না, কারণ তাঁর কবিতা শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করার বদলে তাদের স্নায়ুর স্থিতাবস্থায় বজ্রাঘাত করত। এমনও হয়েছে বহুবার, মঞ্চে কবিতা পাঠ করছেন বীরেন্দ্র। ওদিকে শ্রোতাদের আসন ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে এক-এক করে। তারা অবিচল বসে থাকতে পারছেন না, কারণ তাদের কানে তখন ভেসে আসছে প্রতিবাদের কম্বুকণ্ঠ; শহুরে সন্তোষের স্নায়ুতে কবি চালাচ্ছেন উত্তরোত্তর কুঠারাঘাত। মঞ্চে পাঠ করছেন : 'একটি মেয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে যন্ত্রণায়/বিবর্ণ তার নয়নদুটি, কিন্তু বড় মিঠে/ একটি ছেলে জানেনা, তাই অঘোর নিদ্রা যায়/ জানলে পরে থাকত এখন পঙ্খিরাজের পিঠে' অথবা 'যদি মরতেই হয়,/শুয়োরের মত নয়, যাদের পিছনে শিকারিরা/ ক্ষ্যাপা কুকুরদের লেলিয়ে দিয়ে/তাড়া করে নিয়ে যায় অসম্মানের গহ্বরের দিকে, তারপর/যাদের অভিশপ্ত ভাগ্যকে নিয়ে/হাসতে হাসতে খুঁচিয়ে হত্যা করে।'
আরও পড়ুন
গিন্সবার্গের কবিতা ছাপিয়ে খেটেছেন জেলও; প্রয়াত মার্কিন কবি ও প্রকাশক লরেন্স ফারলিংহেটি
মানুষ এবং কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো আদর্শগত দূরত্ব ছিল না। মানুষ বীরেন্দ্রকে যে-সমস্ত বিষয় ভাবাত, সেই বিষয়গুলোই ফিরে আসত তাঁর কবিতায়। দারিদ্র ছিল তাঁর আজীবনের নিত্যসঙ্গী, তবু মাথা নোওয়াননি কারোর কাছে কোনোদিন। বুঝেছেন মানুষের যন্ত্রণা, লিখেছেন অভুক্ত মানুষের জন্য, লিখেছেন — '...অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে/ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।' আবার 'যে রাস্তায় তুমি হাঁটো' কবিতায় লিখছেন, 'যে রাস্তায় হাঁটো তুমি একটার পর একটা বন্ধ দরজা/সারবন্দি ক্ষুধার্ত মানুষ।'
কবি নিজেও তো কম ক্ষুধার্ত থাকতেন না, তবু সেই ক্ষুধাকে দোসর করে 'উপোসেও হাসিমুখ রেখে' বেরিয়ে পড়তেন গ্রামবাংলার মাঠেঘাটে, মফস্বলের বইমেলাতে। প্রায়শই দেখা যেত বইমেলায় ঘুরে-ঘুরে ফিরি করছেন নিজের এবং অন্য অনেক অখ্যাত কবির বই। তাঁর শালপ্রাংশু অথচ সহজসরল উন্নতশির ব্যক্তিত্ব তখন মাটিতে নেমে এসেছে। তাঁর হাত থেকে কোনো একটি বই নিয়ে পাতা উল্টোতেই চোখের সামনে দিয়ে সাদা পাতার ওপর বয়ে যেতে থাকল পবিত্র শব্দলাভা : 'আমার ক্ষুধার রাজ্যে যে কোনও শব্দের মধ্যে/এখন প্রার্থনা থেকে মন্ত্র/সব থেকে পবিত্র আগুন/পবিত্র আগুন থেকে মৃত্যু পেতে পারি।' ('সভা ভেঙে গেলে')।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যতখানি বাংলা ভাষার কবি, ততখানিই আন্তর্জাতিক। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, চিন থেকে যুগোস্লাভিয়া, যখনই কোনও অন্যায় ঘটেছে, অস্থির হয়েছে কবির বিশ্বমন। কখনও লিখেছেন 'নাচো হার্লেমের কন্যা, নরকের উর্বশী আমার/বিস্ফারিত স্তনচূড়া, নগ্ন উরু,...লিতবসনা/.../নাচো নিগ্রো নাম মুছে দিতে/.../নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক করতে স্বর্গ ও হার্লেম।' ঠিক একইরকম প্রতিবাদে উজ্জ্বল আরেকটি কবিতা 'আফ্রিকা : মার-খাওয়া ভাইয়ের মুখ'-এ বলেছেন, 'মানচিত্রের চেহারা বদলাতে/জল্লাদ এসেছে ঘুরেফিরে নানাবেশে।'
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতা যতখানি লিখেছেন, বলেছেনও ততখানিই। চলতি কথা-বলার ভাষায় লেখা স্লোগানধর্মী ওঁর কবিতাগুলি সম্পূর্ণ স্বকীয় একটি আঙ্গিকের, যেখানে কবিতা হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ আর প্রতিবাদই কবিতা। এই প্রতিবাদ নিজেই খুঁজে নিয়েছে নিজের ছন্দ, হয়ে উঠেছে 'আগুন হাতে প্রেমের গান' (শঙ্খ ঘোষ)। ১৯৮৫ সালে আজকের দিনে (১১ই জুলাই) প্রয়াত হন কবি বীরেন্দ্র। তাঁর জন্মের শতবর্ষেও আমরা কতটা তাঁর কবিতা, তাঁর দর্শন নিয়ে ভাবছি, চর্চা করছি জানি না। সব অর্থেই বিচ্ছিন্নতা যাপনের এই ক্রান্তিকালে হয়তো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাঠ ও যাপন থেকেও আমরা খানিকটা চ্যুত। তবে এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি। আমরা নতুন করে পড়তে, জানতে, বুঝতে পারি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। কীরকম হওয়া উচিত সেই পাঠ, তা কবি নিজেই বলে গিয়েছেন : 'সমগ্রে নয়, এসো, আমাকে বিচ্ছিন্নে পাঠ করো।'
Powered by Froala Editor