ইরানে ভালোবাসার ভারতীয় মুসাফির হয়েছিলেন নীলাঞ্জন হাজরা। পেশায় সাংবাদিক। সেই সূত্রে তিনি যেতেই পারতেন ইরান নামক বিশ্ব-কূটনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম দেশটিতে। তিনি সেভাবে যাননি এবং যেতে চাননি। ইরান নাকি মোল্লাতন্ত্রের দেশ, ধর্মান্ধতায় আকীর্ণ এবং পুরুষতান্ত্রিকতার রূপ সেখানে ভয়ঙ্কর! এইসব বিশ্বের কিছু স্বার্থান্ধ দেশের পরিকল্পিত বিশ্বমনে ছড়িয়ে দেওয়া সংবাদের সত্যতা যাচাই বা পরখ করার নিগূঢ় অভীপ্সা মনে বহন করে তিনি উড়ান দিয়েছিলেন ইরানে এবং তাঁর কথামতো তিনি মন-পছন্দের জায়গাগুলিতে আনন্দ-ঘন অনুভূতি নিয়ে ‘টইটই’ করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি হিন্দ্-এর মুসাফির, ইরানিদের অতি প্রিয় মানুষ— এমন পরিচয়ে আপ্যায়িত হয়েছেন ইরানে প্রথম দিন থেকে সফরের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। সে সব বৃত্তান্ত নিবিড়, স্নিগ্ধ ভালোবাসা ভরা মন নিয়ে তিনি পেশ করেছেন পাঠকসমীপে। তারই ফসল ‘ইরানে’ নামক বিচিত্র সজ্জায় (চিত্রে-আলোকচিত্রে) সাজিয়ে তোলা বইটি। প্রথমেই মন কেড়ে নেয় একটি ছোট্ট মানচিত্র, নকশাধারী— তাতে ইরানের যে স্থানগুলিতে তিনি ক্লান্তি-শ্রান্তিহীন পদচারণা করে ভাষাহারা আবেগে পৃষ্ঠায় ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে ক্ষমতার বিন্যাস’ সংক্ষিপ্ত তালিকায় উপস্থাপন করেছেন যাতে ইরানকে তিনি কী ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তা যেমন স্পষ্ট হয়, একই সঙ্গে তাঁর সাংবাদিক মনের প্রভাবেও লক্ষ করা যায়।
তাঁর লেখা ‘ভূমিকা’ থেকে ইরান সম্পর্কে তাঁর প্রচারিত ও প্রচলিত ধ্যানধারণা-মুক্ত স্বচ্ছ অভিমত বুঝতে অসুবিধে হয় না এবং এটিও বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর নিজ বিশ্বাস ও মতামত যে সঠিক সে সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তিন সপ্তাহ ধরে দেশটির এগারোটি স্থান ঘুরে সাধারণ মানুষদের জীবনের কথা আন্তরিকভাবে জেনে নিতে চেয়েছেন। ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর শুরু হয়ে তাঁর সেই ভালোবাসার ভ্রমণ আশ্চর্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে শেষ হয়েছিল একমাস পূর্ণ হওয়ার দিন সাতেক আগে। তিনি সাংবাদিক বা পর্যটক হয়ে সে দেশে না গিয়ে ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ভ্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এবং তাঁদের সহযোগিতায় সে দেশে পৌঁছে পছন্দমতো স্থান বেছে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ইরানের বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরেছেন, দেখেছেন কত কিছু আর সেই সঙ্গে সহযোগী তরুণ-তরুণীদের অকৃত্রিম ভালোবাসার উত্তাপে দূর করতে সমর্থ হয়েছিলেন অজানা-অচেনা শহর-পরিবেশ-দেশের মানুষজনদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার, অপ্রত্যক্ষিত মনের মধ্যে বয়ে চলা, শৈত্যপ্রবাহ। ‘ভূমিকা’-তে দু’টি বিষয়ে তিনি প্রথমেই তাঁর দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন— ১. ইরান দেশটির ‘কঠিনতম অর্থনৈতিক অবরোধ’ এবং ২. ‘পশ্চিমি প্রোপাগান্ডার পান্ডা’-দের দ্বারা সযত্নে নির্মিত বিশ্বের পিছিয়ে থাকা দেশের মানুষদের ‘মগজ ধোলাই’। ‘বিপজ্জনক মোল্লাতন্ত্রে’র কাল্পনিক তত্ত্বকে বাস্তব সত্য হিসেবে প্রচার করার ব্যাপকতা ইরানের পায়ে ‘অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধের শিকল’ পরানোর প্রয়োজনীয়তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে সহায়ক হয়েছিল। এই তত্ত্বের সত্যতা যাচাই করার লক্ষ্য নিয়ে লেখক হোটেলে না থেকে বন্ধুদের বাড়িতে থেকেছেন, পথ-চলতি দেশবাসীদের সঙ্গে মিলে-মিশে আলাপ করেছেন এবং নিজ-নির্দিষ্ট শহরগুলির নিজ-পছন্দের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-শিল্প-চারুকলা-সাহিত্যচর্চাকেন্দ্র ইত্যাদি সম্পদ-সম্ভার মন ও নয়ন উভয় মেলে দেখে অনুপম আনন্দে হৃদয় ভরিয়ে দেশে ফিরেছেন বিষাদ-ঘন বিচ্ছেদে-বেদনাভর বহন করে।
‘ভূমিকা’-তেই তিনি তাঁর অর্জিত সত্য-সম্পদ তুলে ধরেছেন সুগভীর অকপটতায়— ‘ইরানের সঙ্গে ভারতবাসীর যে নাড়ির যোগ,... আমরা যে ভাষা বলি, যে পোশাক পরি, যে গান গাই, যে সাহিত্য পড়ি, যে বাড়িঘরে থাকি তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইরান।... তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ফসলের শিকড়ে নদীর জলসিঞ্চনের মতো— দীর্ঘ স্বাভাবিকতায় নীরবে অলক্ষ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। ইঞ্জেকশন দিয়ে নয়।’ ইরানের সঙ্গে ভারতের এইপ্রকার সম্পর্ক-ভাবনা তাঁর নিজস্ব অর্জন এবং সেই অর্জন তাঁর পর্যেবক্ষণশক্তির বিশিষ্টতার পরিচয় তুলে ধরে।
আরও পড়ুন
চৈতন্য এই ঘনকালো, হাত-পা কাটা জগন্নাথের বুকের ভিতরেই মিলিয়ে গিয়েছিলেন?
আরও পড়ুন
লাইট ইন ব্যাবিলন ও কাঁটাতার পেরোনো গান
নয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটি পড়তে পড়তে লিখে চলেছি আমার পাঠক-মনের ভালো লাগার ঘোর-প্রসূত কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া। বিস্তারিত বয়ানে নয়, অবশ্যই সংক্ষেপে। যে যে বিষয়ে আমার পাঠক-সত্তা সমৃদ্ধ হয়েছে সে সব লিখতে গেলে লেখা স্থূলকলেবর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বারণ-কল্পে কেবল মুগ্ধতার উপকরণগুলি উপস্থাপন করা যাক। যে দম্পতি লেখকের কাছের মানুষ হয়ে প্রথম তাঁকে আপ্যায়িত করেন ইরানে তাঁরা হলেন সৈয়দ ও তহমিনেহ্। ‘হিন্দ-এর মুসাফির’কে তাঁরা পরম সমাদরে বরণ করেন নিজ পরিবারে। তাঁকে সাহায্য করেছেন, সফরসঙ্গী হয়েছেন অ-দেখা তাঁর ইরানের বন্ধু-বান্ধবীরা। তহমিনেহ্ শেষ দিনেও পাশে থেকেছেন। মেয়েরাই সংখ্যায় বেশি। তিনি অবাক চোখে তা দেখেছেন আর ভেবেছেন, এই দেশের কট্টর পুরুষতান্ত্রিকতা তাহলে বানানো গল্প? বাস্তব নয়? আর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে উপভোগ করেছেন এই দেশের মানুষদের অবিশ্বাস্য অতিথিপরায়ণতা। প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত লব্ধ অভিজ্ঞতা তাঁর কলমে প্রকাশ পেয়েছে এ ভাবে— ‘ইরানি মেহমাননওয়াজির প্রথম আস্বাদ পাই, শেষদিন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে যার একবারও, একটিবারও অন্যথা দেখিনি।’ প্রথম দিন তেহরান বিমানবন্দর থেকে জিনিসপত্র নেওয়ার পর সবথেকে ভারী সুটকেসটি টেনে নিয়ে যাওয়ার (সেটাই রীতি, ট্রলি নয়) ভারটি বন্ধু সৈয়দ এক প্রকার ‘মারামারি’ করেই নিয়ে নিল গাড়ি পার্কিং করার জায়গায় যেতে। সেই শুরু, যা চলেছিল সফর-সমাপ্তির দিন পর্যন্ত। অচেনা ইরানিরাও তাকে ‘মুসাফির’গণ্য করে কত যে খাতির করেছেন ও সুবিধে দিয়েছেন! বিনিময়ে টাকা নেওয়া! তাঁদের জন্য যেন অভাবনীয়! তিনি যে সে দেশের ‘মুসাফির’!
আরও পড়ুন
স্বপ্ন, সন্তান, শিশুশ্রম - এক গতানুগতিক হেরে যাওয়া আমাদের
আরও পড়ুন
স্বদেশকে চিনতে গেলে দেবেশদার লেখার কাছে ফিরতেই হবে
লেখক জানিয়েছেন, ‘ইরানিরা শুধু ভোজনরসিকই নয়, অক্লান্ত ভোজক।’ লেখকের বর্ণনা থেকে পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারেন যে, লেখকও কম ‘ভোজনরসিক’ নন! বইটির প্রথমাংশেই এবং সমগ্র বইটিতে ইরানিদের ভোজ্য পদার্থগুলির বিস্তারিত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এবং সে সব পড়ে তেমন সত্যই প্রতিভাত হয়। ‘নুন ব্যারবেরি’ নামক প্রকাণ্ড আকারের রুটির কথা জেনে পাঠকেরও লেখকের মতো চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠার কথা। ছবির মতো চিত্র কথায় এঁকেছেন তিনি— ‘কম সে কম আড়াই ফুট বাই এক ফুট। ইঞ্চিখানেক পুরু। গায়ে তিলের প্রলেপ।’ ঘরে তৈরি হয় না। দোকান থেকে আনিয়ে নিয়ে একটা প্লেটে মাঝখানে সেই বিশাল রুটিকে রেখে চারপাশে প্যানির, মধু, ম্যারব্বা, জলপাই, খেজুর, আখরোট ইত্যাদির প্লেট রেখে সেখান থেকে সকলে তুলে তুলে নিয়ে খাওয়ার ইরানি রেওয়াজ তিনি বিশেষভাবে উপভোগ করেছেন। হোটেলে ‘আশ’ নামক সবজি, ডাল, মটর মেশানো স্যুপ ব্যুফে হিসেবে নিয়ে পেট ভরে খাওয়ার পর জানতে পারলেন, মেনু কার্ড অনুযায়ী ডিনারের অর্ডার তিনি দেননি। ‘আশ’এর জন্য মূল্য দিতে হয় না। ওটা ‘প্রেপারেতরি’। অতএব অজানিতে তিনি ডিনার সেরে ফেলেছেন এবং তার জন্য তাঁকে অর্থব্যয় করতে হল না। অদ্ভুত দেশ! কেউ খাটে শোয় না। মেঝেতে শয্যা। আসবাবপত্রের বহর নেই বাড়িতে বাড়িতে। হোটেলেও খাটে বসে খাওয়া। কত কি আরও অদ্ভুত তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ‘বিপুল’ মনে হয়েছে— বেড়াল, কাঠবিড়ালি, পেস্তা, শিরাজের বাজার— চলমান মহাবাজার, বাঘা বাঘা শহর...! ইরানের গ্রান্ড বাজারের কথা তুলে কত কিছুই তিনি জানালেন— ‘বাজার’ ফারসি শব্দ। তবে আমাদের হাট-বাজারের সঙ্গে ইরানের বাজারের আকাশ-পাতাল তফাৎ। ‘বিশাল-বিশাল’, ‘নতুন নতুন’ ব্যাপার। তিনি সে সবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য চমৎকার তুলে ধরেছেন, পাঠক জানবেন বলে। বর্ণনা করার সাধ্যি নেই বলেও বিস্তারিত বর্ণনাই দিয়েছেন অজানা বহু বস্তুসামগ্রীর কথা জানিয়ে। জানিয়েছেন ‘হ্যামমম’ বা গণচানঘর-এর কথা। ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে পাঠককে অবগত করার মতো তথ্যবহুল বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন। পাঠকমাত্রেই সমৃদ্ধ হবেন। ‘জাত মুসাফির’ বলেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথকে। বস্তুত তাঁর লেখা ছোট্ট বই ‘পারস্যে’ পড়ে তিনি ইরান দেখার আগেই অএনক কিছু যেন জেনে ফেলেছিলেন। ১৯৩২-এ রবীন্দ্রনাথের দেখা ইরানের বহু বদল ঘটেছে। ইরানবাসী তরুণরা তার জন্য লড়ছে— ‘স্বাধীনতা তারা আদায় করে নিচ্ছে, পদে পদে, পোষাকে-আশাকে, শিক্ষায়, ধর্মাচরণে, দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটিতে।’ তিনি ইন্টারনেটের দৌলতে প্রাপ্ত বন্ধু-বান্ধবীদের আচরণ থেকে, যা জানার জন্য ইরান-ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তা জেনে নিয়েছেন সরেজমিনে। সৈয়দ, তহমিনেহ, মেহদি, শিমা, ফয়িজেহ্, সোমাইয়েহ্, মালিহে, এলনাজ নামক তরুণ-তরুণীরা তাঁর সঙ্গে ঘুরেছেন, ‘আড্ডা’ দিয়েছেন, হোটেলে খেয়েছেন সহজ, অনাবিল, অনাড়ষ্ট ভঙ্গিতে। অধ্যাপক মহম্মদ ফক্র ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি তাঁর সঙ্গে বিশ্ব-কূটনীতি ও তাঁর দেশের অবস্থান সম্পর্কে যুক্তিবাদী আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন। ধর্মান্ধতার গন্ধমাত্র লেখক সেই সংস্পর্শে পাননি। বরং তিনি সবিস্ময়ে অনুধাবন করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা বিষয়ে তাঁর যে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন ২০১৫ সালে তিনি, তাতে ২০১৯-এ বইটি লিখতে বসে তখন তাঁকে ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা পয়গম্বর’ মনে হয়েছে লেখকের।
‘পশ্চিম আজেরবাইজান প্রদেশের একরত্তি শহর খোই’ হয়ে পূর্ব আজেরবাইজানের ত্যাবরিজ়-এ যাওয়ার পরিকল্পনা লেখকের সফর-স্বপ্নের অন্যতম ছিল। খোই-এ কেউ যায় না। তিনি শাম্স অল-দিন মহম্মদ ওরফে শামস-ই ত্যাবরিজ়ি, সংক্ষেপে শামস-এর সমাধি দেখা নামক তীর্থযাত্রা সফল করার জন্য খোই-এর পথে পা বাড়িয়েছিলেন। আলোচ্য বইয়ের লেখক তাঁর পাঠকদের বিস্মিত করে দিয়ে যেমন কাব্যপ্রীতির বেনজির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর ভ্রমণকথায় সেইসঙ্গে ভোজ্যবস্তুর প্রতি আকর্ষণ ও যত্রতত্র জানিয়ে ফেলেছেন বইটিতে। পঞ্চম অধ্যায়ে তাই শামস্-ই ত্যাবরিজ়ির ফারসি প্রেমের কবিতার সংকলন গ্রন্থ সম্পর্কে যেমন আবেগ-উচ্ছ্বাসের বাক্যায়ন ঘটিয়েছেন তেমন খোই-এর চেলো ক্যাবব সম্পর্কে লিখেছেন— সেই খাদ্যবস্তুটির জন্য ‘কলকাতা থেকে খোই পাড়ি দেওয়া যেতে পারে।’ হোজালি নামক রেস্তোরাঁটির চেলো মুখে দেওয়া মাত্র যে স্বাদ মেলে তা অনির্বচনীয়। এই প্রকার ভোজনরসিক মানুষটি জানিয়েছিলেন একটি সভায়— ‘আমি খোই আসিনি। শামস্ আমায় খোই এনেছেন।’ সুফী সাধক এই প্রকৃত দরবেশ প্রাণের মানুষটির টানেই তিনি খোই ছুটে গিয়েছিলেন। মরমী কবি রুমি এই মানুষটির সঙ্গেই বিচ্ছেদ-জ্বালা সহ্য করতে না পেরে লিখেছিলেন— ‘তিনটি কথার বাড়া আর কিচ্ছু তো নেই/পুড়ে গেছি আমি, জ্বলে গেছি আমি, জ্বলে-পুড়ে গেছি আমি।’ কঠিন হলেও ‘তরজমা’ করে পাঠকদের প্রাণের তারে লেখক আঘাত হেনেছেন, সুর-মূর্ছনা তৈরি হবে বলে। খোই-এর পর তিনি গেছেন ত্যাবরিজ়, ইসফাহান, শিরাজ, নিশাবুর— প্রভৃতি দ্রষ্টব্য স্থানে।
অতঃপর শেষ করেন ইরান-সফর তিনি একটি কবরস্তানে গিয়ে। একটি ‘জীর্ণ কবরখানা’— কবি ফুরুঘ ফারোখজ়াদ-এর। মাত্র ১২৭টি কবিতা লিখে প্রচুর ধিক্কার কুড়িয়ে প্রয়াত হন। অথচ লেখকের যাওয়ার দিনেই সেখানে মোমবাতি আর কবিতার বই হাতে তরুণী বসে কবিতা পড়ছেন— দেখলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গিনী তহমিনেহ্। ফুরুঘের কবিতা।— ‘কথা বলো আমার সাথে।/জানালা আমার আশ্রয়/আমার যে যোগাযোগ সূর্যের সাথে’ লেখক শেষ করেছেন সফর-কথা— ‘এই তো সভ্যতা। হাজার হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, ধনতন্ত্রীয় ভোগবাদী দাপটে ফাটল ধরিয়ে প্রমাণিত হচ্ছে কবিতা ঘাসের মতোই অপারজেয়।’
‘ইরানে’ পড়তে পড়তে কত কিছু জানা হল সে সবের পূর্ণ ব্যাখ্যান এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া নয়। সামান্য ঝলক মাত্র। লেখককে জানা-চেনা হল একটি বইতেই তার নানাবিধ সত্তার প্রকাশে। তবে সব ছাপিয়ে পরিস্ফূট হয়েছে তাঁর অমল প্রাণের কাব্যপ্রেম আর দেশ, কাল, ধর্ম, বর্ণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষকে মানুষরূপে দেখার আকুতি ও আহ্বান।
গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা গুরুভার বইতে গিয়ে একটু লঘুতার দিকে ঝুঁকেছেন। তবু এমন ভ্রমণগাথা দ্বিতীয়বার প্রকাশ করে নিঃসন্দেহে পাঠককুলের উপকারসাধন করেছেন। সুখ্যাত শিল্পী হিরণ মিত্র-কৃত বইটির অঙ্গসজ্জা প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না। তবে লেখক নীলাঞ্জন হাজরা যে একজন প্রতিভাবান ফোটোগ্রাফারও— সে কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বইটির চেহারা নিয়ে একটু ‘কিন্তু’ পাঠকমনে ছাপ ফেলতে পারে কেননা, লেখকের সযত্নে তোলা ফোটোগ্রাফগুলি বিষয়বস্তু ও গুণমানে নিখুঁত সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও বইটির চেহারায় কিছু ঘাটতি সেগুলির জন্য পরিমিত পরিসর (বা ক্যানভাস) দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটুকু খুঁত উপেক্ষা করতে পারলে আলোচ্য বইপাঠে প্রাপ্তির ভাগ ষোল আনা বলেই মানতে হবে।
(ইরানে, নীলাঞ্জন হাজরা, প্রথম গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশ, বইমেলা, ২০২০, মূল্য: ৪৫০ টাকা)
Powered by Froala Editor