আনপ্রেডিক্টেবল! হ্যাঁ, শেষ দৃশ্যে এসে এই কথাটা মনে হতে বাধ্য। কথা হচ্ছে পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্যের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে। প্রায় ২ বছর আগে তৈরি হয়ে যাওয়া সিনেমাটি করোনা অতিমারীর দুর্যোগ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের মুখ দেখল। এর মধ্যে অনেক সিনেমাই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে। অরিন্দম ভট্টাচার্য সেই পথে হাঁটেননি। ভালোই করেছেন। কারণ এমন একটা গল্প অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের বড়ো পর্দায় না দেখলে অনেককিছুই হারাতে হবে। ইংরেজি রহস্য উপন্যাস সম্পর্কে একটা বিশেষণ প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। নেইল বাইটিং। অর্থাৎ কাহিনি যত এগোতে থাকে পাঠক ততই নখ কামড়াতে থাকেন। অবশ্য নখ কামড়ানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু ‘অন্তর্ধান’ (Antardhaan) সিনেমাটি যে আগাগোড়া নেইল বাইটিং, তাতে সন্দেহ নেই।
গল্পটি সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা উচিৎ নয়। রহস্যের পর্দা নামানোই থাকুক। আর অভিনয় নিয়েও আলাদা করে বলার কিছু থাকে না। পরমব্রত এবং তনুশ্রী দুজনেই নিজের নিজের ভূমিকায় সমান সাবলীল। তেমনই সহজ চলাফেরা মমতা শঙ্করের। তবে সবাইকে আড়াল করে দেন রজতাভ দত্ত। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া দুঁদে গোয়ান্দা নীলাদ্রি সেন (রজতাভ দত্ত)। তবে ৩ বছর ধরে ইনসোমনিয়ায় ভুগছেন তিনি। তাই টানটান রহস্যের মাঝেও থেকে থেকে হাই তুলতে থাকেন তিনি। সামান্য হাই তোলার দৃশ্যকেও যে এমন প্রাণবন্ত এবং সাবলীল করে তোলা যায়, সেটা হয়তো একমাত্র রজতাভ দত্তই প্রমাণ করতে পারেন। সিআইডি বিভাগের আর এক অফিসারের ভূমিকায় তেমনই অবাক করেছেন অক্ষয় কাপুর। কাহিনিতে তাঁর যতটা গুরুত্ব রয়েছে, সেই তুলনায় স্ক্রিন পাননি অক্ষয়। অথচ তার মধ্যেই বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন, তাঁকে ছাড়া সিনেমাটির এক পা-ও এগোনোর উপায় নেই।
বাংলা সিনেমায় দীর্ঘদিন কোনো সার্থক মৌলিক রহস্যগল্প তৈরি হয়নি বললেই চলে। অর্থাৎ উপন্যাসের পাতায় যেমন রহস্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠক দীর্ঘকাল পরিচিত। সিনেমার পর্দায় এই ধরনের গল্পকে তুলে ধরতে গেলে কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়। ‘অন্তর্ধান’ দেখতে দেখতেও তাই বেশ কিছু জায়গায় মনে হতে পারে, দৃশ্যগুলি বুঝি অনেকক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। সত্যিই তো, এক প্রবাসী বাঙালি দম্পতির একমাত্র মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি বিভাগের সবচেয়ে অভিজ্ঞ অফিসার ঘটনার তদন্ত করছেন। সেখানে মিসেস রায় অর্থাৎ মমতা শঙ্করের তন্ত্রসাধনা এবং মিস্টার চ্যাটার্জি অর্থাৎ পরমব্রতর তাই নিয়ে অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের প্রয়োজন কোথায়? শেষ দৃশ্যের আগে পর্যন্ত এই প্রয়োজন বোঝা সম্ভব নয়। তেমনই বোঝা সম্ভব নয় কোন প্রথম দৃশ্যে ঠিক কোন দুর্বিষহ স্মৃতি জনৈক কমল ধাওয়ানকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
আরও পড়ুন
পরোটার টানে রজতাভর ‘অন্তর্ধান’, মুখ গম্ভীর পরমব্রতর
আরও পড়ুন
পাহাড়ি 'অন্তর্ধান' ও রনি-গোয়েন্দার কিসসা
নিছক রহস্য গল্পের আড়ালে শেষ পর্যন্ত অন্য এক অপরাধের গল্প বলে যায় ‘অন্তর্ধান’। এই অন্তর্ধান হয়তো শিশুকন্যাটির নয়, বরং সমাজের ক্ষমতাবান মানুষদের। ক্ষমতার আড়ালে যাঁরা নিজেদের অপরাধকে লুকিয়ে রাখেন। সেখানে বিচারব্যবস্থাকেও হার মানতে হয়। ঠিক যেমন ৫টি শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী ডাঃ বিজেন্দর সিং আইনের চোখের সামনে সদর্পে ঘুরে বেড়াতে পারেন। আমাদের আশেপাশেও এমন মানুষের সংখ্যা তো নেহাত কম নয়। শেষ পর্যন্ত মনে পড়ে যায় এডওয়ার্ড কনসোলের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘দ্য কোর্স অফ জাস্টিস অফেন প্রিভেন্টস ইট’। তবে শেষ পর্যন্ত সুদিন আসে। তাই রহস্যের সমাধানে ব্যর্থ নীলাদ্রি সেনও সাবলীলভাবে হেসে ওঠেন। কর্মজীবনে হেরে গেলেও জিতে গিয়েছে তাঁর বিবেক।
আরও একটি প্রশংসা করার মতো বিষয়, হিমাচলপ্রদেশের অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যেও ক্যামেরা কোথাও বিষয়বস্তু থেকে সরে যায়নি। প্রাকৃতিক দৃশ্যকে তুলে ধরা হয়েছে ঠিকই। তবে সেই মনোরম পরিবেশ কখনও রহস্যের পারদকে নিম্নমুখী হতে দেয়নি। তবে রহস্য এবং প্রকৃত অপরাধের পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক সময়েই সিনেমার স্বচ্ছন্দ গতি বাধা পেয়েছে। শেষ দৃশ্যে সমস্ত সমীকরণ মিলিয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাই বহুবার মনে হতে পারে, রহস্যের মূল অক্ষ থেকে সরে যাচ্ছে গল্প। শেষ দৃশ্যে অবশ্য সবই মিলে যায়। অবশ্য থেকে যায় একটি অতৃপ্তিও। নীলাদ্রি সেনের জীবনের অনেকটা অংশ তখনও না-বলা। অথচ তাঁর জীবনের গল্পও যে খুব সাধারণ নয়, তার ইঙ্গিত বহুবার পাওয়া গিয়েছে। হয়তো আগামী কোনো সিনেমায় সেই গল্পগুলোকেই সম্পূর্ণ করবেন পরিচালক। অন্তত তার সম্পূর্ণ সুযোগ থেকে যায়। আর ‘অন্তর্ধান’-এর পর নীলাদ্রি সেনের চরিত্রে রজতাভ দত্তকে আবার ফিরে পেতে যে দর্শক উন্মুখ হয়ে থাকবেন, তাতে সন্দেহ নেই।
Powered by Froala Editor