সাজানো ঘরের ড্রয়িংরুমে বসেছে এক কাল্পনিক আদালত। অভিযুক্ত আপাতভাবে নিরপরাধ। যেমনটা আমরা সবাই দাবি করি। অন্তত আইনের চোখে নিরপরাধ তো বটেই। তবে কে বলতে পারে, কোনো এক কানাগলিতে হয়তো ঘাপটি মেরে রয়েছে ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধের স্মৃতি। তার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জিঘাংসা, রক্ত, প্রতিশোধের ক্লেদ। কে খুঁজে বের করবে সেই অপরাধ? কে তার বিচার করবে? শাস্তিই বা দেবে কে? সেই অপরাধের মূল অনুসন্ধান করতেই প্রথাগত আইনের বাইরে গিয়ে বসেছে একটি কাল্পনিক আদালত। সেই ‘মক ট্রায়াল’-এর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়েই তৈরি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের (Kamaleshwar Mukherjee) নতুন ছবি ‘অনুসন্ধান’ (Anusandhan)।
‘মক কোর্ট’ বিষয়টি নতুন নয়। নাটকে তো বটেই, অসংখ্য সিনেমাতেও ঘুরেফিরে এসেছে এই কাঠামো। যে মূল কাহিনিকে অবলম্বন করে নির্মিত কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের এই সিনেমা, ফ্রেডরিক ডিউরেনম্যাটের লেখা ‘আ ডেঞ্জারাস গেম’ নামের সেই গল্প নিয়েও এর আগে পৃথিবীর নানা ভাষায় একাধিক নাটক তৈরি হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তৈরি হয়েছে ‘ট্র্যাপ’, ‘জাজমেন্ট অ্যান্ড দ্য হ্যাংম্যান’। বাংলায় ‘চোপ আদালত চলছে’, ‘তৃতীয় নয়ন’ নামে দুটি নাটকও হয়েছে। কিছুদিন আগে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেই মঞ্চস্থ হয়েছে ‘প্লে হাউস’। এই সিনেমার ক্ষেত্রে অবশ্য এডগার ওয়েলসের ‘দ্য ফোর জাস্ট মেন’ এবং মোপাসাঁর ‘লে ভলিওর’ গল্পদুটিরও কিছু প্রভাব রয়েছে। তবে এই সিনেমা শুধু মক ট্রায়ালের কাহিনি নয়। একটি থ্রিলার হিসাবেও দেখা যায় সিনেমাটি। আবার দেখা যায় একটি রাজনৈতিক শিল্পবস্তু হিসাবেও।
রাজনীতি কেন? কারণ রাজনীতি তো আসলে এক আদর্শের কথা বলে। অথচ আজকের পুঁজিলীন সমাজে সমস্ত আদর্শকে পিছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হয় সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। তেমনই এক সময়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠে এসেছেন এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ইন্দ্র (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। বামপন্থী আদর্শে দীক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান তিনি। শুধুই আদর্শবাদী নন, গরিব পরিবারেরও সন্তান তিনি। বাবা-মায়ের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও একটি সারসত্য বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে একটু একটু করে উপরে উঠতে গেলে আদর্শের কাছে মাথা নিচু করলে চলে না। সেখানে এমন অনেককিছুই করতে হয়, মূল্যবোধ যাকে প্রশ্ন করে। অবশ্য আইনের চোখে সেগুলো কোনোটাই অপরাধ নয়। ইন্দ্রও তাই ঠান্ডা মাথায় শ্রমিক আন্দোলনের নেতার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আন্দোলন দমন করে। কারণ না হলে বহুজাতিক কোম্পানি তাদের সংস্থাকে ‘টেক ওভার’ করবে না। অভাবের সংসার থেকে উঠে আসা ইন্দ্র থারপর থিতু হন ব্রিটেনে। কিন্তু সাময়িক সাফল্যেও থেমে থাকতে চান না তিনি। একটার পর একটা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিজের গোপনে লালন করতে শুরু করেন হিংসার বীজ।
কোম্পানির বসের স্ত্রীকে মিথ্যা প্রণয়ের জালে জড়ান ইন্দ্র। তাঁকে ব্যবহার করেন নিজের উচ্চাশা চরিতার্থ করার টোপ হিসাবে। আর এই পরকীয়া সম্পর্কের অভিঘাতেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় তাঁর বসের। এও কি একটি হত্যা নয়? অথচ হত্যার প্রমাণ কোথায়? মদ্যপ ইন্দ্রর নিজের জবানিতেই উঠে আসতে থাকে এইসব ঘাত-প্রতিঘাতের কথা। আর সেইসঙ্গে উঠে আসে একটি প্রশ্নও। অপরাধ কী? উচ্চাশা কি অপরাধ? কর্মজীবনের সফল হওয়ার চেষ্টা করা কি অপরাধ? অথচ এইসব না-অপরাধের ভিতরেই লুকিয়ে থেকে যায় ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধের বীজ। কে বলতে পারে, কর্পোরেট দুনিয়ার প্রতিযোগিতায় হয়তো আমাদের মধ্যেও এমন কোনো অপরাধের স্ফুলিঙ্গ ঢুকে পড়েছে। কোনো এক সময়ে সেই স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে পারে।
সিনেমার নির্মাণে এবং কলজেতেও এই সম্ভাবনাগুলোকেই লালন করেছেন পরিচালক। নির্মাণ বলতে কেবল তার কারিগরি দিকগুলি নয়। সেইসঙ্গে প্রতিটা দৃশ্যের সজ্জা, কাহিনির বিস্তার, সবটা জুড়েই ছড়িয়ে আছে নানা প্রশ্ন। হয়তো সিনেমা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই মূল পরিণতির জায়গাটা বুঝতে পারবেন দর্শকরা। কিন্তু ক্রমশ যুক্তির সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সেই অন্তিম পরিণতিতে পৌঁছানোর রাস্তাটি দেখার আগ্রহই হলের মধ্যে বসিয়ে রাখে দর্শককে। ধীর গতিতে এগোলেও কাহিনি সবসময় টানটান। আর সম্পূর্ণ সিনেমাটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন একঝাঁক দাপুটে অভিনেতা। কিছু কিছু মুহূর্তে বিচারক গায়ত্রীর ভূমিকায় চূর্ণী গাঙ্গুলির অভিব্যক্তি অসাধারণ। তাঁর স্বামী প্রশাসন পিনাকী সামন্তর চরিত্রে সমানভাবে সঙ্গত করে গিয়েছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। পাবলিক প্রসিকিউটার বিনায়কের চরিত্রে ঋদ্ধি সেনের অভিনয়ও যথেষ্ট ভালো। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী মেধার ভূমিকায় প্রিয়াঙ্কা সরকারও যথাযথ। ইন্দ্রর স্ত্রী এবং অবৈধ প্রণয়ীর চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা মণ্ডল এবং পায়েল সরকারও বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। খুব অল্প উপস্থিতিতেই কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি একজন দক্ষ অভিনেতাও। আর শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আবারও প্রমাণ করলেন, অভিব্যক্তির কাটাছেঁড়ায় তাঁকে কোনো সীমানায় আটকে রাখা যায় না।
এই সিনেমার আরও একটি প্রশংসা করার মতো দিক হল, বেশ কিছু জায়গায় সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন। ইন্দ্রের জীবনটি তো রয়েছেই। আবার আইনজীবী পরিবারটির মধ্যেও দেখা যায় ছেলে বিনায়কের প্রতি মা-বাবার পক্ষপাতদুষ্টতা। আবার ভাই-বোন মেধা ও বিনায়কের মধ্যেও একটা চাপা প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। শেষ পর্যন্ত ছবিটিকে থ্রিলারের গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখেননি পরিচালক। অবশ্য সেটা ভালোই করেছেন। সিনেমাটিকে ক্রাইম থ্রিলার বললে হয়তো ঠিকই বলা হয়। আবার কেউ মনে করতে পারেন, এই সিনেমার আধিভৌতিক উপাদানই মূল বস্তু। আবার কারোর মনে হয়ে পারে, সম্পূর্ণ কাহিনিটাই আসলে ইন্দ্রের নিজের গহীন খুঁড়ে দেখার এক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা। প্রতিটি সম্ভাবনার রাস্তাই দর্শকদের জন্য খোলা রেখেছেন পরিচালক।
আবার ইন্দ্রের অবৈধ সম্পর্কের প্রসঙ্গটিতে কমলেশ্বরের পূর্ববর্তী সিনেমা ‘ক্ষত’-র একটি আভাসও পাওয়া যায়। একই মানসিক অভিঘাত থেকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যায় দুটি কাহিনিতেই। তবে ‘অনুসন্ধান’-এ সেই অভিঘাত এসেছে একটু অন্যভাবে। যদিও দুই জায়গাতেই ফিরে এসেছে প্রতিশোধ এবং নীতিহীনতার কথাও। সম্পর্কের দ্বন্দ্বের এই প্রসঙ্গটি অবশ্য নতুন নয়। মনে রাখতে হবে, ডিউরেনম্যাটের গল্পটির বয়সও ৬৫ বছর। তবে পুরনো সেই গল্পই এখানে হয়ে উঠেছে সমকালের দর্পণ। অথবা সর্বকালের কাহিনি। আর তাই হয়তো চরিত্রগুলির নামকরণেও পৌরাণিক অনুষঙ্গ এনেছেন পরিচালক। তবে সর্বকালের মধ্যেও বর্তমানকে খোঁজার চেষ্টাটাই বেশি করে চোখে পড়ে।
এমন একটা গল্পের কাঠামো নিয়ে কাজ করেছেন কমলেশ্বর, যেখানে নাটকের উপাদান রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। গল্পটির বুননেও রয়েছে নাটকের ছাপ। তাই সিনেমার পর্দায় তাকে ফুটিয়ে তোলা সহজ ছিল না। কিন্তু এখানেও যথেষ্ট মুন্সীয়ানার ছাপ রেখেছেন চিত্রগ্রাহক টুবান। কয়েকটি ছোটোখাটো ত্রুটি সরিয়ে রাখলে ঘরের দৃশ্যগুলির মধ্যে একটা গম্ভীর মেজাজকে ধরে রাখতে পেরেছেন পুরোপুরি। পরিপাটি সম্পাদনা করেছেন রবিরঞ্জন মৈত্রও। একেবারে শেষে অনুপম রায়ের ‘আমি অনেক দূরের মানুষ’ গানটির মেজাজও সিনেমার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। অনুপম রায়ও যেন খানিকটা অচেনাভাবে ধরা দিলেন এখানে।
তবে এতকিছুর মধ্যেও কি কোথাও কোনো ত্রুটি নেই? নিখুঁত সিনেমা বলে বোধহয় সত্যিই কিছু হয় না। এই সিনেমাতেও তাই চোখে পড়ার মতো কিছু ত্রুটিও আছে, না পড়ার মতো কিছু ত্রুটিও আছে। তবে শিল্পের মূল উদ্দেশ্য যদি অভিঘাত তৈরি হয়, তাহলে ‘অনুসন্ধান’ সম্পূর্ণ সফল। এই ক্ষয়িষ্ণু সময়কে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আসলে আমাদের প্রত্যেকের সামনেই একটা আয়না তুলে ধরেছেন কমলেশ্বর। সিনেমার শেষে হয়তো প্রত্যেক দর্শকই নিজেদের মধ্যে কোনো এক অপরাধের অনুসন্ধান করতে শুরু করবেন। কিন্তু সেই অপরাধের বিচার হবে কোথায়? কে দেবে শাস্তি? অপরাধের যেমন কোনো সংজ্ঞা নেই, শাস্তিরও কি কোনো সংজ্ঞা আছে?
Powered by Froala Editor