সংরক্ষণের পথে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ‘প্রাণকেন্দ্র’ রক্সবার্গ হাউস

ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার প্রসঙ্গে উঠলে সামনে উঠে আসে দুটি নাম। জোহান জেরহার্ড কনিগ এবং উইলিয়াম রক্সবার্গ (William Roxburgh)। প্রথমজন পরিচিত ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনক হিসাবে, দ্বিতীয়জনের পরিচয় ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার প্রতিষ্ঠানিক জনক। জন্মগতভাবে স্কটিশ হলেও রক্সবার্গ হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার বাসিন্দা। এমনকি কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের যে গৌরব আজ বিশ্বজুড়ে— তাঁর নেপথ্যে রয়েছেন এই স্কটিশ উদ্ভিদবিদই। 

১৭৮৮ সাল। শিবপুরের নিকটবর্তী ৩১০ একর জমির উপর বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলেন ব্রিটিশ সাহেব রবার্ট কিড। স্থানীয় উদ্ভিদ প্রজাতি সংগ্রহ এবং তাদের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। কর্নেল কিডের মৃত্যুর পর ১৭৯৩ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন রক্সবার্গ। সে-সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনে জায়গা পেয়েছিল কেবলমাত্র ৩০০টি উদ্ভিদ প্রজাতি। ক্রমাগত সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে রক্সবার্গের তত্ত্বাবধানে। শুধু উদ্ভিদ প্রজাতি সংগ্রহই নয়, ভারতীয় উদ্ভিদের প্রজাতি অন্যত্র, ভিন্নতর পরিবেশে আদৌ জন্মাতে পারে কিনা কিংবা অন্যান্য অঞ্চলের প্রজাতি এ-দেশের মাটিতে বাড়তে পারে কিনা— তা নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন রক্সবার্গ। শন, তিসি, জায়ফল-সহ একাধিক ভারতীয় প্রজাতির আবিষ্কর্তা তিনি। তাছাড়া বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফ্রেঞ্চ অলিভ, জামাইকান স্পাইস-সহ একাধিক বিদেশি প্রজাতি জায়গা পেয়েছিল তাঁর দৌলতেই। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৮১৩ সালে তাঁর অবসরগ্রহণের সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের মোট সংগ্রহের তালিকা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫০০ প্রজাতিতে। যার মধ্যে ২৫৩৩টি প্রজাতির সচিত্রিত বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ নথিভুক্ত করেছিলেন রক্সবার্গ। এমনকি তিনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট থাকার সময়ই বিশ্বের বৃহত্তম বাগানের তকমা পায় কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে যে তকমা ছিল কলকাতার ঝুলিতে। 

আশ্চর্যের বিষয় হল, কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন শুধু তাঁর কর্মক্ষেত্রই ছিল না, বরং ছিল আবাসস্থলও। ১৭৯৩ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দায়িত্ব নেওয়ার পর, এই বাগানেই রক্সবার্গ গড়ে তুলেছিলেন এক আস্ত বাংলো। সেটাই ছিল তাঁর অফিস, বাড়ি, এমনকি গবেষণাগারও। সে-সময় ইউরোপের একাধিক খ্যাতনামা উদ্ভিদবিদ এসে থেকেওছেন এই বাড়িতে। সবমিলিয়ে এই ভবনকে তৎকালীন বোটানিক্যাল গার্ডেনের ‘প্রাণকেন্দ্র’ বললেও ভুল হয় না এতটুকু।

দেশ স্বাধীনের পর থেকেই ধীরে ধীরে প্রাধান্য হারায় ‘রক্সবার্গ হাউস’-খ্যাত (Roxburgh House) এই ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যটি। ক্রমাগত গড়ে ওঠে বহু নতুন পরিকাঠামো। বদলে যায় অফিসও। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পরিচর্যার অভাব ও অবহেলার শিকার হয় ঐতিহ্যবাহী ভবনটি। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ঐতিহাসিক এই বাড়ি সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন বিজ্ঞানীরা। শেষ পর্যন্ত এবার গতি পেল সেই প্রকল্প। 

গতবছরই এই বাড়ি সংস্কারের সবুজ সংকেত দিয়েছিল প্রশাসন। এবার কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফোরাম, রক্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়ে চলেছে সংরক্ষণ প্রকল্প। শুধু মূল ভবনটির সংস্কারই নয়, একইসঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ওল্ড হার্বেরিয়াম সেন্টার এবং ওল্ড সিড স্টোর নামে পরিচিত আরও দুটি ভবনও সংরক্ষণ করা হবে বলেই জানাচ্ছে বোটানিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষ… 

Powered by Froala Editor