সময়টা ১৫১১ সাল। অর্থাৎ আজ থেকে ৫০০ বছরেরও বেশি আগে। ইতালিতে তখন নবজাগরণের পাশাপাশি শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সমস্ত যুগপরিবির্তনের সময়েই যা হয়। সেইসময় প্লেগের আক্রমণে মারা গেলেন এক চিকিৎসক। তাঁর ছিলেন এক শিল্পী বন্ধু। বন্ধুর প্রয়ানে শিল্পীও বিব্রত। কিন্তু এমন সময় যখন সেই চিকিৎসকের দেহ ব্যবচ্ছেদের সময় এল, তখন কিন্তু সমস্ত গোঁড়ামি সরিয়ে ফেলে সেই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন তিনি। ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে যুক্তিবাদী মনন তৈরি করাই তাঁদের প্রত্যেকের জীবনের ব্রত। অন্যান্য চিকিৎসকরা মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করছেন, শিল্পী তখন তাঁর নোটবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর হৃৎপিণ্ডটা বের করতেই শুরু করে দিলেন স্কেচ।
সেই শিল্পী আর কেউ নন, পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তাঁকে আমরা মূলত চিনি মোনালিসা, সালভাদার মুন্ডি বা লাস্ট সাপারের মতো ছবির জন্য। কিন্তু এসবের বাইরেও যে তাঁর এক ধরনের বৈজ্ঞানিক মানসিকতা ছিল, তার খবর কেউই সেভাবে রাখিনি। একটু আধটু জানি বটে, এরোপ্লেন বা বাইসাইকেলের ডিজাইনও নাকি তিনি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু অ্যানাটমির খেত্রেও তাঁর যে বিরাট অবদান, সেটা কতটুকুই বা মনে রেখেছি?
ভিঞ্চির অ্যানাটমি চর্চার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ভিট্রুভিয়ান ম্যানের কথা। একটা বৃত্তাকার ক্ষেত্রের মধ্যে মানুষের শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুপাত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছিলেন সেখানে। তবে অ্যানাটমির চর্চা সেই একটি ড্রয়িং-এ সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৫০৭-০৮ সাল নাগাদ নতুন একখানি নোটবুক নিয়ে শুরু করেছিলেন অ্যানাটমির চর্চা। আর এই কাজে সবসময় সাহায্য পেয়েছেন চিকিৎসক মার্কান্টোনিও ডেলা টোর-এর কাছ থেকে। তাঁর অপারেশনের সময় পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কেচ নিতেন ভিঞ্চি। মস্তিষ্ক, খাদ্যনালীর পাশাপাশি এই সময় তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি সুষুম্নাকাণ্ডের স্কেচ।
তবে এরপর প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন টোর। সেইসময় তাঁর দেহব্যবচ্ছেদের সময় এঁকেছিলেন হৃৎপিণ্ডের স্কেচ। আর এই স্কেচকে ঘিরে ৫০০ বছর ধরে ঘিরে ছিল এক রহস্য। আমাদের চেনা বইতে হৃৎপিণ্ডের ছবি যেমন দেখি, তার থেকে এটা সামান্য আলাদা। এখানে একটা আলাদা পেশির অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়। সেটা কি শিল্পীর কল্পনা? অন্তত তেমনটাই মনে করতেন অনেকে। কিন্তু সম্প্রতি ‘নেচার’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, এই পেশি একেবারেই কাল্পনিক নয়। বরং মানুষের হৃৎপিণ্ডে সত্যিই অস্তিত্ব আছে এমন ট্রাবেকুলার। ভ্রূণাবস্থাতেই এই পেশির জন্ম হয়। কিন্তু অন্যান্য পেশির আড়ালে তা সাধারণত চাপা পড়ে থাকে। তবে হাইপারটেনশন বা অন্যান্য রোগের ফলে ফুলে উঠতে পারে এই পেশি। তখন খালি চোখেও তার অস্তিত্ব বোঝা যায়।
আরও পড়ুন
বয়স পেরিয়েছে ১০০, তবুও আঁকায় খামতি নেই পুনের এই ‘তরুণী’র
সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে শিল্পীর কৃতিত্বকে বুঝতে সাহায্য করবে। কিন্তু তার পরেও, সেইসময়ের ধর্মান্ধ সমাজে শবদেহ ব্যবচ্ছদ যখন ছিল রীতিমতো পাপ, তখন একজন শিল্পীর এমন কাজের মূল্যায়ন সত্যিই কঠিন। শিল্পকলার আড়ালে সেই বৈজ্ঞানিক মানসিকতা কি আদৌ প্রচারের আলো পাবে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ট্রেনের কামরায় আঁকা সহজপাঠের ছবি ও কবিতা, চমক শিয়ালদা রেল কর্তৃপক্ষের