একটি নয়, দুটি চাঁদ ছিল পৃথিবীর— বলছে গবেষণা

চাঁদ নিয়ে আকর্ষণের শেষ নেই মানুষের মনে। গানে-কবিতায়-প্রবাদে বারবার ফিরে আসে চাঁদের জুতসই উপমা। প্রিয় মানুষের রূপবর্ণনায় তার জুরি মেলা ভার। কোনো কবির কাছে আবার গদ্যময় পৃথিবীতে চাঁদ ‘ঝলসানো রুটি’। এক চাঁদেই এই অবস্থা! কিন্তু কেমন হত, যদি দুটি চাঁদ (Two Moon) থাকত? একসময় কিন্তু সত্যিই দুটি চাঁদ ছিল পৃথিবীর (Earth)। গবেষণায় উঠে আসছে সেরকমই তথ্য।

প্রায় ১০ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীর চারদিকে সমান তালে পাক খেয়েছে ‘দ্বিতীয় চাঁদ’টি। আকারে অবশ্য খুব একটা বড়ো ছিল না। চওড়ায় মাত্র ১২০০ কিমি। অর্থাৎ বর্তমান চাঁদের এক-তৃতীয়াংশ, ভরের দিক থেকে এক চতুরাংশ। তারপর নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে এসে আছড়ে পড়ে বর্তমান চাঁদের গায়ে। দুটিতে মিলে তৈরি করে একটি চাঁদ। এই সংঘর্ষের অসংখ্য চিহ্ন রয়ে গেছে চাঁদের পিঠে। বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপ্রযুক্তির সাহায্যে খুঁজে পেয়েছেন তার প্রমাণ। 

প্রায় একই সময়ে জন্ম হয় দুই চাঁদের। একটি মতে, ‘থিয়া’ নামের মঙ্গল গ্রহের সমানাকৃতির একটি গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীকে ঘিরে তৈরি হয় একটি বলয়। যার নাম ডেবরিস বলয়। যা থেকে পরে তৈরি হয় চাঁদ। আর সেই সংঘর্ষেই জন্ম হয় ‘দ্বিতীয় চাঁদ’-এর। পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত যদি সমকৌণিক রেখা টেনে একটি ত্রিভুজ তৈরি করা যায়, তবে আরেকটি বিন্দু যেখানে মিলিত হয়, তাকে বলা হয় ‘ট্রোজান পয়েন্ট’। সেই তৃতীয় বিন্দুতেই অবস্থিত ছিল সে।

স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী ও বর্তমান চাঁদ থেকে খুব বেশি দূরত্বে ছিল না উপগ্রহটি। চাঁদের কক্ষপথ ক্রমশ বর্ধিত হতে থাকায় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে সেটি। সে কারণে নিজের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে এসে আঘাত করে ‘দ্বিতীয় চাঁদ’। আরেকটি মতে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে না পেরে আকারে ছোট দ্বিতীয়টি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে চাঁদের সঙ্গে। সংঘর্ষের গতিবেগ ছিল প্রতি ঘন্টায় ৭২০০-১০৮০০ কিলোমিটার। তারপর আরও কয়েক লক্ষ বছর সময় নিয়ে ক্রমে মিশে যায় চাঁদের সঙ্গে।

আরও পড়ুন
মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই জন্ম নিয়েছিল চাঁদ, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা

তবে চন্দ্রপৃষ্ঠে আজও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সে। পৃথিবীবাসী মূলত দেখতে পায় চাঁদের একটি দিক। তুলনায় অজ্ঞাত, আঁধারে মোড়া অপর প্রান্ত। শেষ ছিল না কৌতূহলের। ১৯৫৯-এ রাশিয়ান চন্দ্রযান লুনা-৩-এর মাধ্যমে প্রথম পাওয়া যায় সেই পৃষ্ঠের ছবি। এই দিকেই ভেঙে পড়েছিল দ্বিতীয় চাঁদ। যার ফলে চাঁদের দুটি মেরুর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য পার্থক্য। 

আরও পড়ুন
চাঁদের জন্ম কীভাবে? প্রচলিত ধারণা বদলে দিল সুপার কম্পিউটার

চাঁদের যে দিক দেখা যায়, অর্থাৎ কাছের দিকটির জমি নিচু ও সমান। মহাকাশযান অবস্থানের ক্ষেত্রে তুলনায় আদর্শ। কিন্তু বিপরীত দিকে পরিমাণ বেশি পাহাড়-পর্বতের। সে-প্রান্তে জমির উচ্চতা বেড়ে যায় প্রায় ২ কিমি। আরেকটি প্রমাণও দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের এপারে সন্ধান মিলেছে ‘মারিয়া’ নামের একধরনের আগ্নেয় পাথরের। অপর প্রান্তে কিন্তু তার পরিমাণ খুবই কম। 

চাঁদের অভ্যন্তরভাগে অবশ্য মিশে গেছে ‘দ্বিতীয়’-টির মৌলপদার্থগুলি। লক্ষ লক্ষ বছরের প্রক্রিয়ায় এ পৃষ্ঠেও পাওয়া যায় তার নমুনা। ফসফরাস, তেজস্ক্রিয় পটাসিয়াম, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম জাতীয় যে পদার্থগুলির নিদর্শন মিলেছে, সেগুলি ‘দ্বিতীয় চাঁদ’-এর অংশ হতে পারে বলে অনুমান। এছাড়াও আছে পৃথিবীরই কিছু দুষ্প্রাপ্য ধাতুর নমুনা। যা জোরদার করছে দ্বিতীয় চাঁদের অস্তিত্ব ও পরবর্তী সংঘর্ষের ধারণা। 

আরও তথ্যের জন্য অপেক্ষা করে আছেন বিজ্ঞানীরা। কীভাবে দুই চাঁদে সংঘর্ষ হল? কোন তত্ত্বটি সঠিক? চাঁদের বিভিন্ন অংশের মাটি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার পরেই আসা যাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। 

তথ্যসূত্র :
Early Earth may have had two moons, nature, 2011
Earth had two moons, new model suggests, national geographic, 2011
Earth had two moons that crashed to form one, study suggests, space.com, 2011

Powered by Froala Editor