২৬ জানুয়ারি ভারতের ‘স্বাধীনতা দিবস’, পালিত হয়েছে দীর্ঘ ১৭ বছর!

ভারতবর্ষ জুড়ে তখন বিপ্লবের জোয়ার। পথে ঘাটে ধ্বনিত হচ্ছে ‘গো ব্যাক সাইমন’। বছর কয়েক আগেই ১৯২০ সালে ভারতে ফিরেছেন গান্ধীজি। শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। সেই আন্দোলনেরই অন্যতম এক সৈনিক লালা লাজপত রাই। লাহোরে তখন বিপ্লবী তৈরির কারখানা তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। লাহোর ন্যাশনাল কলেজ। তরুণ প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতেই এই উদ্যোগ। তবে ১৯২৭ সালেই প্রাণ হারালেন তিনি। ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির আঘাতে লাহোর স্টেশনেই থেঁতলে গেল লাজপত রাইয়ের মাথা। আর সেই ঘটনাই যেন নতুন করে আগুন জ্বালিয়ে দিল দেশের বুকে। সেদিনের লাজপত রাইয়ের আত্মত্যাগই পারতপক্ষে জন্ম দিয়েছিল প্রজাতন্ত্র দিবসের।

অবশ্য ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ হতে ঢের দেরি তার তখনও। অখণ্ড ভারতে স্বাধীনতা দিবস হিসাবেই পালিত হত ২৬ জানুয়ারি। লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় নড়ে চড়ে বসেছিল জাতীয় কংগ্রেস। দাবি উঠেছিল ভারতের সাংবিধানিক পুনর্গঠনের। জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি তখন মতিলাল নেহরু। ১৯২৮ সালে তাঁর তত্ত্ববধানেই প্রকাশিত হল নেহরু রিপোর্ট। ব্রিটিশদের কাছে দাবি উঠল স্বাধীনতার। তবে সে দাবি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনেই কংগ্রেসের স্ব-সরকার প্রতিষ্ঠার।

ঠিক তার পরের বছরই, ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন মতিলাল নেহরুর পুত্র জওহরলাল নেহরু। জাতীয় কংগ্রেসের দায়িত্বে এসে প্রথমেই বাবার তৈরি রিপোর্ট বরখাস্ত করেন তিনি। সরব হন ব্রিটিশ শাসকের অধীনস্থ না থেলে পূর্ণ-স্বরাজের জন্য। তবে ব্রিটিশ আধিপত্যেই স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতে অনড় ছিল হোম রুল লিগ এবং মুসলিম লিগ। অন্যদিকে বাল গঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিনচন্দ্র পালের মতো নেতারা সমর্থন করেন নেহরুর পূর্ণ-স্বরাজের দাবিকে।

১৯২৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে নির্বাচনের মাধ্যমে পাশ হয় ঐতিহাসিক পূর্ণ-স্বরাজের কর্মসূচি। ঠিক হয় ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষা না করেই পালিত হবে ‘স্বাধীনতা দিবস’। পরাধীন ভারতেই। পরিকল্পনা করা হয় ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত জুড়ে কংগ্রেস পার্টি পালন করবে ‘পূর্ণ স্বরাজ দিবস’।

পরিকল্পনা মাফিকই কাজ হয়। ২৫ জানুয়ারি মধ্যরাতে লাহোরের বাদশাহী মসজিদ, দেরা সাহেব গুরুদ্বার এবং লাহোর কেল্লায় জওহরলাল নেহরু উত্তোলিত করেন তেরঙা ‘স্বরাজ’ পতাকা। পরবর্তীকালে যা ভারতের জাতীয় পতাকার রূপ নিয়েছিল।

১৯৩০ সালের পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর দিনটি এভাবেই পালিত হয়েছে পরাধীন ভারতের ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময় গান্ধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলন, নেতাজির ইম্ফল-আন্দামানে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে একাধিক অভ্যুত্থান টলিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের ভিদ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই তাই শুরু হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টকে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন হিসাবে ধার্য করেন। তবে একাধিক জাতীয় কংগ্রেসের নেতাই বিরোধিতা করেছিলেন মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্তকে। কিন্তু বদলায়নি তাঁর সিদ্ধান্ত। জাপানের আত্ম-সমর্পণের দিনেই ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করেন মাউন্টব্যাটেন। উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও যেন ছাপ থেকে যায় ব্রিটিশ রাজত্বের।

আরও পড়ুন
কলকাতা শহরের নিজস্ব টাইম জোন, প্রচলন ছিল স্বাধীনতার পরেও!

’৪৭-এ ভারত স্বাধীন হল ঠিকই। তবে তখনও কোনো নিজস্ব সংবিধান নেই ভারতের। স্বাধীনতার পরেই শুরু হয় সার্বভৌম ভারতের সংবিধান রচনার কর্মসূচি। রাজগোপালচারী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লাভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নলিনীরঞ্জন ঘোষকে নিয়ে গঠিন হল বিশেষ কমিশন। ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় লেগেছিল সেই সংবিধান প্রবর্তনে।

তবে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান রচনার কাজ শেষ হলেও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু চাননি তখনই তা প্রকাশ করতে। বরং ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় স্বাধীন ভারতের সংবিধান। নেহরু চেয়েছিলেন সংবিধানের এই প্রকাশ যেন পালিত হয় বিশেষভাবে। সেইসঙ্গে ভারতবাসীর স্মৃতিতে যেন গেঁথে যায় স্বরাজ দিবসের ইতিহাস। সেদিন ভারতের শেষ গভর্নর রাজা গোপালাচারীর হাতেই প্রকাশিত হয় সেই সংবিধান। আকাশে ডানা মেলে ত্রিবর্ণ পতাকা। স্বাধীনতা দিবসের আবহেই পালিত হয় দিনটি। তবে নামটুকু বদলে যায় শুধু। ‘স্বরাজ দিবস’ থেকে দিনটার নতুন পরিচিতি হয় প্রজাতন্ত্র দিবস...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘হিন্দু-বিরোধী’ অভিযোগে বাদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম; শহিদ-তালিকা ঘিরে বিক্ষোভ

More From Author See More