দাসত্বের গ্লানি নিয়েই কেটেছে তাঁর কৈশোর-যৌবন। শিকার হয়েছেন অকথ্য অত্যাচারেরও। তবে হার মানেননি। বরং, আমেরিকায় দাসত্বের অবসানের জন্যই লড়াই করেছিলেন তিনি। এমনকি তার আগে থেকেই ক্রীতদাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে আমেরিকার বুকে গড়ে তুলেছিলেন এক আশ্চর্য নেটওয়ার্ক। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে সহস্রাধিক মানুষকে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। সুযোগ দিয়েছিলেন নতুন জীবন শুরু করার। এবার তাঁকে সম্মান জানিয়েই নিউজার্সির নেওয়াক স্কোয়ারে গড়ে উঠল বিশেষ মূর্তি ‘শ্যাডো অফ আ ফেস’।
হ্যারিয়েট টুবম্যান (Harriet Tubman)। আমেরিকার অ্যাবোলিস্ট মুভমেন্টের অন্যতম নেতৃত্ব তিনি। তাছাড়া তাঁকে কৃষ্ণাঙ্গ এবং মহিলা অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ বলতেও ভুল হয় না এতটুকু।
১৮২২ সাল। হ্যারিয়েটের জন্ম ম্যারিল্যান্ডের একটি দাস পরিবারে। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন নেটিভ আমেরিকান। তাই জন্মগতভাবেই দাসত্বের বোঝা চেপেছিল তাঁর কাঁধে। বেত্রাঘাত সহ্য করে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হত সারাদিন। এর মধ্যে ঘটে যায় আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের শুরুর দিক সেটা। হ্যারিয়েটের মাথায় ভারী লোহার বাটখারা ছুঁড়ে মেরেছিলেন তাঁর মালিক। রক্তপাত তো বটেই, একইসঙ্গে হাইপারসোমনিয়ার শিকার হন তিনি। দেহের ভারসাম্য রাখতেও সমস্যা হত তাঁর। এই ঘটনার পরেই ম্যারিল্যান্ড থেকে পালিয়ে যান তিনি। আশ্রয় নেন ফিলাডেলফিয়ায়। তবে খুব বেশিদিন সেখানে মন টেকেনি। পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য দাসদের মুক্ত করতেই ফের মেরিল্যান্ডে ফিরে আসেন তিনি। রেললাইন, স্টেশন ও অন্যান্য নির্মাণ কার্যের সঙ্গে জড়িত ক্রীতদাসদের নিয়ে গড়ে তোলেন নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্ক ধরেই তাঁদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন অন্যত্র।
পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধেও ইউনিয়ন আর্মির হয়ে তিনি সামিল হয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানেও। প্রাথমিকভাবে রাঁধুনির ভূমিকা পালন করতেন তিনি। পরে হয়ে ওঠেন ক্ষুরধার গুপ্তচর। ৬০-এর দশকে দাসত্ব অবলুপ্ত হওয়ার পর মহিলা এবং কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার নিয়েও বিস্তর কাজ করেছিলেন হ্যারিয়েট।
তবে ২৫ ফুট লম্বা হ্যারিয়েটের এই মুখাবয়বের মূর্তি শুধু কিংবদন্তি সমাজকর্মীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই নয়, মুছল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। কী সেই অধ্যায়? আসলে নেওয়ার্ক স্কোয়ারে প্রায় দু’শো বছরেরও বেশি সময় ধরেই দাঁড়িয়েছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি। এই শ্বেতাঙ্গ পর্তুগিজ সাহেবই আমেরিকার আবিষ্কারক। এমনটাই পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই কেন? আমরাও কি পাঠ্যপুস্তকে পড়িনি যে ভারতেরও আবিষ্কর্তা তিনি? অথচ, সত্যিই কি আবিষ্কর্তা ছিলেন তিনি? তারও যে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই অস্তিত্ব ছিল ভারত কিংবা আমেরিকার। সেখানে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। অথচ, সেই অতীতকে মুছে ফেলে নতুনভাবে শ্বেতাঙ্গরা ইতিহাস লেখা শুরু করেছিল কলম্বাসের ভারত কিংবা আমেরিকা আগমন নিয়ে। তাছাড়া কলম্বাসের আগমনের পর থেকেই শুরু হয় ঔপনিবেশিক রাজত্ব।
উল্লেখ্য, এই প্রেক্ষিতেই ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে নেমেছিলেন সামাজিক এবং অধিকারকর্মীরা। দাবি তুলেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি অপসারণের। এবার সেই মূর্তি সরিয়েই স্থাপিত হল হ্যারিয়েট টুবম্যানের মুখাবয়ব। নেটিভ আমেরিকান এবং অত্যাচারিত ক্রীতদাসদের ইতিহাস সংরক্ষণের প্রেক্ষিতে এটি বড়ো জয় বলেই মনে করছেন মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের একাংশ।
Powered by Froala Editor