ফিরে দেখা ২০২১ : চলে গেলেন যেসব স্বনামধন্য বাঙালি (প্রথম পর্ব)

/১১

শেষ হতে চলেছে আরও একটি বছর। হাসি-কান্নার ভেলায় ভাসানো ২০২১ সাল। এই এক বছরে আমরা যেমন অনেককিছু পেয়েছি, তেমনই হারিয়েছি অনেককে। অতিমারী করোনার প্রকোপ তো চলেছেই। বছর শেষে ফিরে দেখা যাক সেইসব কিংবদন্তি বাঙালিদের, গত এক বছরে যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। প্রহরের পাতায় থাকল তাঁদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা।

/১১

আলি তাহের মজুমদার (২৩ জানুয়ারি) – বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সেনানী তিনি। কাজ করেছেন নেতাজির গুপ্তচর হয়েও। ১৯১৭ সালে কুমিল্লার চাঁদপুরে জন্ম আলি তাহের মজুমদারের। গান্ধীবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যোগ দিয়েছেন স্বদেশি আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছুদিন রোজগারের দায়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। তারপর যোগ দিয়েছেন নেতাজির গুপ্তচর বাহিনীতে। দেশভাগের পর বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন তিনি। নেতাজির জন্মদিনেই প্রাণ হারালেন তাঁর অনুচর।

/১১

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ (৪ ফেব্রুয়ারি) – ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রথম সারিতে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পরে পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক হিসাবে। ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছিলেন তিনি। আর্যদের গো-মাংস ভক্ষণের ইতিহাস খুঁজে দেখার পাশাপাশি আরও নানা প্রচলিত ভুল ধারণা ভেঙেছেন তিনি। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ। তাঁর মৃত্যুতে ইতিহাস গবেষণার জগত অনেকটাই রিক্ত হল।

/১১

অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ ফেব্রুয়ারি) – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র অমিতেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে যোগ করেছিলেন একটি নতুন মাত্রা। চিনা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা এবং অনুবাদের কাজে নিজেকে লিপ্ত রেখেছেন সারা জীবন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও মিশিগান ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি ভারতের ন্যাশানাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতেও চিনা ভাষা বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। চিনা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন লাওৎসে-র লেখা ‘তাও-তে-চিং’ নিয়ে তাঁর গবেষণা ও বঙ্গানুবাদ এক দিকচিহ্ন হিসাবে গণ্য করা হয়। ৯৮ বছরেও অমিতেন্দ্রনাথের গবেষণা উদ্যম কমেনি এতটুকু। তাঁর মৃত্যু তাই সবার কাছেই ছিল আকস্মিক।

/১১

রমানাথ রায় (১৫ মার্চ) – বাংলা সাহিত্যে শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ তিনি। লিখেছেন ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’, ‘কাঁকন’, ‘অন্যায় করিনি’, ‘ভালোবাসা চাই’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোটোগল্প। সাহিত্যে কঠোর বাস্তবতার গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি মিশে গিয়েছেন ফ্যান্টাসির জগতেও। শৈলীর সঙ্গে বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্য রাখতেও শিখিয়েছেন রমানাথ। ৬০-৭০-এর দশকের ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে সাহিত্যিকরা, রমানাথ তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রমানাথ রায়ের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য একজন অভিভাবককে হারাল।

/১১

শঙ্খ ঘোষ (২১ এপ্রিল) – তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক, তা হয়ে পড়বে নগণ্য। অথবা নেহাতই বাতুলতা। তিনি নিজেই তাঁর পরিচয়। একদিকে কবি, প্রাবন্ধিক আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচক, সেইসঙ্গে রবীন্দ্র গবেষকও। বাংলা সাহিত্যের জগতে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন বটবৃক্ষদের একজন। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি, জ্ঞানপীঠ সহ অজস্র পুরস্কার। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘বাবরের প্রার্থনা’-র মতো কবিতার মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটা নতুন যুগ। শেষ কয়েক বছর অবশ্য তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে কেড়ে নিল জীবন।

/১১

অনীশ দেব (২৮ এপ্রিল) – শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞান এবং রোমাঞ্চ কাহিনিকে আশ্রয় করেই নিজের লেখক পরিচিতি গড়ে তুলেছেন, এমন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাম অবশ্যই অনীশ দেব। হার্ড সায়েন্স ফিকশনের পাশাপাশি তাঁর বেশিরভাগ কাহিনিতে মিলেমিশে গিয়েছে ফ্যান্টাসি এবং সমাজচেতনাও। ‘২৩ ঘণ্টা ৬০ মিনিট’ এবং ‘৬০ মিনিট ২৩ ঘণ্টা’ দেখিয়েছে এক ডিস্টোপিয়ান সমাজকে। নিজ গুণেই বাকিদের চেয়ে পৃথক হয়ে উঠেছিলেন অনীশ। কোভিডেই শেষ হল তাঁর জীবন।

/১১

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৬ মে) – বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার জগতে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন যেমন ব্যতিক্রমী, তেমনই জনপ্রিয়। ‘আনন্দবাজার’, ‘যুগান্তর’-এর মতো সংবাদপত্রের সাংবাদিকতা দিয়ে পেশায় প্রবেশ ঘটলেও তাঁকে মূলত মানুষ মনে রেখেছেন বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক হিসাবে। অসংখ্য বিতর্কসভার উপস্থাপনা এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকতায় একটা নতুন রূপ হাজির করেছিলেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই মৃত্যু হল তাঁর।

/১১

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩ মে) – ভারতের পরমাণু গবেষণার ইতিহাসে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য একজন বিজ্ঞানী। পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পারমাণবিক শক্তি বিভাগের সচিব পদে ছিলেন দীর্ঘদিন। সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া হোমি ভাবা পরমাণু গবেষণা সংস্থার পরিচালকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে উঠলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বছরই চলে গেলেন তিনি।

১০/১১

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১০ জুন) – একাধারে কবি এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বলা ভালো, তাঁর ছবিগুলিও কবিতার মতোই। ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘তাহাদের কথা’ বা সাম্প্রতিক সময়ে ‘উড়োজাহাজ’, প্রতিটা সিনেমাই একটা অন্য ধরণের ছবি হাজির করে। ২ বার জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে কবিতার চর্চাতেও কখনও ফাঁকি দেননি তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এই বছরই মৃত্যু হল তাঁর।

১১/১১

গৌতম বসু (১৮ জুন) – মাত্র ৭টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তাঁর সাহিত্যের সম্ভার। অথচ তার মধ্যেই নিজেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছিলেন গৌতম বসু। ১৯৮১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’-এর ২২টি শিরোনামহীন স্বল্পদৈর্ঘ্যের কবিতার মধ্যেই শুনিয়েছিলেন এক অন্য স্বর। যেখানে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই। কবিতাই সংযমই ছিল তাঁর অন্যতম পরিচিতি। কবিতা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সেই সংযম বজায় রেখেছিলেন। ২০২১ সালেই সাহিত্যের জগত থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন গৌতম বসু।

Powered by Froala Editor