প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে পারমাণবিক শক্তি। শুধুই ধ্বংস নয়, আগামীদিনে শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠতে চলেছে পরমাণু বিক্রিয়া। আর এই অগ্রগতির রাস্তায় ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম পথিকৃৎ একজন বাঙালি। কলকাতা শহরেই তাঁর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা। করোনা ভাইরাস কেড়ে নিল সেই কিংবদন্তি বিজ্ঞানী শেখর বসুকেও। বৃহস্পতিবার ভোরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
১৯৫২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জন্ম শেখর বসুর। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বেছে নিয়েছিলেন কারিগরি শিক্ষাকেই। মুম্বাইয়ের বীরমাতা জিজাবাই টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক স্তরের ডিগ্রি পেলেন ১৯৭৪ সালে। অবশ্য সেই ডিগ্রি ছিল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর। কিন্তু এরপরেই তাঁর জীবনে ঘটে গেল এক অভাবনীয় পরিবর্তন। কলেজে পড়ার সময়েই ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ট্রেনিং প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। স্নাতক স্তরের পর যোগ দিলেন সেখানেই। আর এভাবেই জড়িয়ে পড়া পরমাণু গবেষণার সঙ্গে।
গবেষণার শুরুটা অবশ্য ছিল জ্বালানি নিয়ে। বিশেষ করে বয়েলিং ওয়াটার রিয়েক্টর তৈরির নানা মডেল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন প্রথমে। সেই গবেষণা অসম্পূর্ণ রেখেই তাঁকে চলে যেতে হয় তামিলনাড়ুর কলাপক্কমে। সেখানে তখন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তুতি চলছে। প্রথমে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রোপালশনের মডেলিং শুরু করলেও পড়ে এই প্রকল্পের প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্বই তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। এরপর পরমাণু গবেষণাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা।
২০০০ সাল থেকে কলাপক্কমের প্রতিটা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মিলিত বোর্ডের ডিরেক্টরের দায়িত্ব সামলেছেন শেখর বসু। এমনকি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে, তাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে শেখর বসুর অবদান অনস্বীকার্য। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একেবারে মূলগত গবেষণার মতো পরিকাঠামো এদেশে নেই। তাই বিদেশের বৈজ্ঞানিক সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রথম থেকেই।
সুযোগ এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি। ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগের প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েই শেখর বসু যোগাযোগ করেন সার্নের সঙ্গে। তামিলনাড়ুর বুকে নিউট্রিনো অবজার্ভেটরি তৈরি পরিকল্পনা হল তখনই। আজ যে প্রকল্প সারা বিশ্বে কণা-পদার্থবিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। এমনকি ভারতের বাইরে বাংলাদেশের রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পিছনেও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
মাত্র দুবছর আগে পর্যন্ত ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন শেখর বসু। ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি। সারা জীবনে পেয়েছেন অজস্র সম্মান। ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান নিউক্লিয়ার সোসাইটির পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে পরপর দুবার পুরস্কৃত হয়েছেন পরমাণু শক্তি বিভাগের তরফ থেকে। ২০১৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি-লিট পদবি দান করে। ২০১৪ সালে পেয়েছেন দেশের সেরা অসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী।
আরও পড়ুন
প্রয়াত বিখ্যাত অজি তারকা ডিন জোনস, মুম্বাইতেই ফেললেন শেষ নিঃশ্বাস
শুধুই শক্তি বিষয়ক গবেষণা নয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন শেখর বসু। সারা দেশে ৬টি হাসপাতালের রূপকার তিনি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপরেই মূলত জোর দিতেন তিনি। বিশেষ করে ক্যানসারের চিকিৎসায় লেজার টেকনোলজির ব্যবহারের পিছনে তাঁর মৌলিক গবেষণার কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নিউক্লিয়ার-সাবমেরিন আরিহান্তের জন্যই সমাধিক পরিচিত। যে মডেল তিনি তৈরি করেছিলেন কলাপক্কমে গবেষণার সময়েই।
আরও অনেক গবেষণাই হয়তো বাকি থেকে গিয়েছিল শেখর বসুর। কিন্তু এর মধ্যেই এসে গেল মহামারী করোনা। কিছুদিন আগেই তাঁর শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তাঁকে সুস্থ করে তোলার। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। অবশেষে মাত্র ৬৮ বছর বয়সে শেষ হল সমস্ত গবেষণা। তবে ইতিমধ্যে তিনি দেশকে যে দিশা দেখিয়ে গিয়েছেন, তার প্রভাব থেকে যাবে আগামী দিনেও। ভবিষ্যতে প্রযুক্তির ইতিহাস অবশ্যই মনে রাখবে এই বাঙালিকে।
তথ্যসূত্রঃ Padma Shri Award for Shri Sekhar Basu, Director, BARC
আরও পড়ুন
অক্সিজেন ছাড়াই দশবার এভারেস্ট জয়, প্রয়াত 'স্নো লেপার্ড' অ্যাং রিটা শেরপা
Powered by Froala Editor