১৯৭২ সাল। বোম্বে। চলছে ‘জীবনরহস্য’ ছবির প্রস্তুতি পর্ব। সেখানেই একটি স্টুডিও-তে রেকর্ড করা হবে এই ছবির গান। গাইবেন আশা ভোঁসলে। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। স্টুডিও-র মধ্যে পা কেটে রক্তাক্ত স্বয়ং সঙ্গীত পরিচালক। তবে এত কিছুর পরেও বদল হল না শিডিউলের। রক্তাক্ত অবস্থাতেই গান রেকর্ড করালেন তিনি।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhijit Bandyopadhyay)। হেমন্ত, মান্না, সলিল চৌধুরীদের মতো বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের অন্যতম তারকা তিনি। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমল চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীর মজুমদার— সঙ্গীতজগতের এই ত্রয়ী সে-সময় পরিচিত ছিলেন ‘সলিল চৌধুরীর স্যাটেলাইট’ নামে। অমল চ্যাটার্জ্জী এবং প্রবীর মজুমদার সুরালোকে পাড়ি দিয়েছিলেন অনেক আগেই। এবার তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
ষাটের দশকে গান যখন বিভাজিত শিল্প— অর্থাৎ, তার সুরকার, গীতিকার এবং কণ্ঠশিল্পী ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি, সেই সময় সঙ্গীতজগতে আত্মপ্রকাশ অভিজিতের। গণনাট্যের হাত ধরে। সলিল চৌধুরীর অবদানও অস্বীকার করার জায়গা নেই সেখানে। শুধুমাত্র অন্যতম সহকারীই নয়, সলিলের শিষ্যও ছিলেন তিনি। তাছাড়াও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন উষারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
তবে সঙ্গীতজগতে তাঁর পরিচিতি গড়ে দেয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘দূরের পাল্লা’ কবিতার সঙ্গীত রূপ। অভিজিৎ সুরারোপ করলেও এই গানটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন সলিল। প্রাথমিকভাবে অভিজিৎবাবু ঠিক করেন কোনো প্রবীণ শিল্পীকে দিয়ে রেকর্ড করাবেন এই গান। তবে বাধ সাধলেন সলিল। জানালেন, প্রবীণ শিল্পীর গায়কী প্রভাবিত করবে এই গানের সমসাময়িকতাকে। বরং, শ্যামল মিত্রের গলায় নতুন চেহারা নেবে এই গান। সেই মতো বন্দোবস্তও হল সবকিছুর। এবার গান ওঠানোর পালা।
আরও পড়ুন
অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা
তখন তিনি সরকারি অফিসে কর্মরত। অফিসের কাজ থেকে ফিরে হাজির হয়েছেন এইচএমভি-র স্টুডিও-তে। কয়েকদিনের মধ্যেই রেকর্ডিং অথচ গানটাই যে তোলানো হয়নি শ্যামল মিত্রকে। তবে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে কথা বলেই চমকে উঠলেন তিনি। সে-গান তাঁর তোলা হয়ে গেছে। আর অভিজিতের অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সেই গান তুলিয়েছেন স্বয়ং সলিল চৌধুরী।
আরও পড়ুন
আইরিস ক্লাবের জার্সিতে বব মার্লের হাস্যমুখ, ফুটবলের সঙ্গে হাত মেলাল সঙ্গীত!
কিংবদন্তি দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্পর্ক ছিল এমনই। সঙ্গীত পরিচালনা এবং সুরকার হিসাবে অভিজিতের প্রচারবিমুখতা নিয়েও, খানিকটা অখুশিই ছিলেন সলিল। চাকরির জন্য গানে মনোনিবেশ করতে পারেন না অভিজিৎ, এমনটা অভিযোগও ছিল সলিলের।
‘দূরের পাল্লা’-ই সঙ্গীতজগতে জনপ্রিয় করে তুলেছিল অভিজিৎকে। এই গানের পরেই স্বাধীন সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে তাঁর কাজ করা শুরু চলচ্চিত্রজগতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, সুবীর সেন, শ্যামল মিত্র— বাংলার স্বর্ণযুগের প্রায় সমস্ত তারকাশিল্পীই গান গেয়েছেন তাঁর সুরে কিংবা কথায়। ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখো’, ‘পাখি উড়ে আয়’, ‘অনেক অরণ্য পার করে’-র মতো গানগুলির কদর এতটুকু কমেনি আজও। একইভাবে শ্রীকান্ত আচার্য কিংবা রূপঙ্করের মতো তরুণ শিল্পীদের সঙ্গেও করেছেন একাধিক কাজ। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি আস্থায় এতটুকু ভাঁটা ছিল না তাঁর।
তবে আধুনিক কিংবা চলচ্চিত্রের গানের বাইরেও অভিজিতের জীবনের অনেকটা অংশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লেখাতেও বার বার ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা, রবীন্দ্রদর্শনের কথা, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নতুনভাবে আত্মস্থ করার কথা। বাংলার সঙ্গীত ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন একাধিক গ্রন্থও। যার মধ্যেও অন্যতম ‘বাংলা গানের পথচলা’। সেখানেও সুস্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রচর্চার কথা।
বেশ কিছু বছর আগেই প্রথাগত সঙ্গীতজগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন কিংবদন্তি সুরকার, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী। তবে সঙ্গীতরচনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি কোনোদিনই। নিজের বাড়িতেই গানের পাঠ দিতেন তরুণ-তরুণীদের। শেষ বয়সে, এমনকি লকডাউনের মধ্যেও স্বরচিত একাধিক গানে সুরারোপ করেছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে সে-সব গানের ঘরোয়া রেকর্ডিং-ও করিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু বাংলার সঙ্গীতে তাঁর এই বিস্তৃত কাজ ও অবদানের পরেও, ক’জন শ্রোতাই বা মনে রেখেছেন তাঁর কথা? তাঁকে নিয়ে চর্চাই বা হয়েছে কতটুকু? একপ্রকার যেন নীরবেই বিদায় নিলেন তিনি। এমন একজন ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়ায় আরও এক অভিভাবক হারাল বাংলার সঙ্গীতজগৎ…
ছবি ও তথ্য ঋণ - সপ্তর্ষি ঘটক
Powered by Froala Editor