কলকাতার থিয়েটার মহল তখন রমরমা। স্টার, মিনার্ভা, মিত্র— মঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভিনেতারা। দূরদূরান্ত থেকে তরুণরা আসছেন অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে। সেরকমই এক গ্রামের ছেলে জহর গাঙ্গুলি চলে এলেন কলকাতায়। মিত্র থিয়েটারে যোগ দিলেও সেভাবে কাজ পাচ্ছেন না। ভিড়ের দৃশ্যে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ চরিত্রে অভিনয় করতে হচ্ছে; সেইসঙ্গে জুটছে সহশিল্পীদের অপমান। এদিকে থাকা-খাওয়ারও ঠিক নেই। কী হবে তাঁর? এমন সময় উদ্ধারকর্তা হয়ে হাজির হলেন ‘চক্কোত্তি’।
জহর গাঙ্গুলিকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন স্টার থিয়েটারে। সেখানে কিংবদন্তি নাট্যকার-অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে। চক্কোত্তি সেখানে নিয়মিত অভিনয় করছেন। জহরকে দাঁড় করিয়ে অপরেশবাবুকে বললেন, ‘স্যার, যদি এঁকে আপনার পায়ের কাছে ঠাই দেন…’ বলে সমস্ত কথা বললেন। কিন্তু এখন তো আর অভিনেতার দরকার নেই! হঠাৎ জহরকে স্তম্ভিত করে দিয়ে, গুরু অপরেশবাবুর পায়ে পড়লেন চক্কোত্তি, তুলসী চক্রবর্তী। স্যার, ও যে ভেসে যাবে। একটিবার দেখুন… একজন বন্ধুর জন্য এতটা করতে এর আগে কাউকে দেখেনি কেউ। এমনই ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী; নির্ভেজাল, সরল ও বিরাট মনের এক মানুষ…
এই নামটি শুনলেই চোখের সামনে চলে আসে এক মাথা টাক, বড়ো বড়ো দুটি চোখ আর কৌতুকময় মুখ। সত্যি, ওই চেহারাতেই না কত কিছু ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তুলসী চক্রবর্তী। তবে কেবল কৌতুকই নয়, সামগ্রিক অভিনয়টাও যে কতটা ভালো করতেন তার প্রমাণ অনেকের কথাতেই পাওয়া গেছে। মঞ্চে দাঁড়ালে তিনি যেন নিজের জগতের রাজা, ওঁকে পরাস্ত করবে কার সাধ্যি! অভিনয়ই যে তাঁর নিয়তি, এই কথাটি বেশ আগেই বুঝে গিয়েছিলেন তুলসীবাবু। আর তার মূল কাণ্ডারী ছিলেন জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তী।
বেশ ছোটো বয়স থেকেই জ্যাঠার কাছে মানুষ হয়েছিলেন। পরিবার বলতে সেখানেই ঠাই ছিল তাঁর। পড়াশোনা করছিলেন বটে; কিন্তু বাবার মৃত্যু সবকিছু বদলে দিল। আর বালক তুলসীর হাল ধরলেন প্রসাদবাবু। তিনি তখন নাটকে-গানে বিভোর। নিজের অর্কেস্ট্রা গ্রুপ আছে, অ্যামেচার নাট্যদলও আছে। সেই স্রোতে ঢুকে গেলেন তুলসী চক্রবর্তীও। তবে অভিনয় নয়, গানে। প্রসাদবাবুর কাছেই গান শেখা তাঁর, সেইসঙ্গে অভিনয়ও। কিন্তু কতদিন আর জ্যাঠার অন্ন ধ্বংস করা যায়! কাজের জন্য বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। একাজ সেকাজ সেরে আবারও এসে ভিড়লেন থিয়েটারে।
গোটা বাংলা তুলসী চক্রবর্তীকে চেনে একজন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে। সিনেমায় নামলেই যেন ওই সহজ, সরল মুখটি ছোট্ট ছোট্ট পার্টে ভুলিয়ে রাখবেন দর্শকদের। হ্যাঁ, সারাজীবন এমন ‘ছোটো পার্ট’-এই কাজ করে গেছেন তিনি। খানিকটা ভুল বলা হল কি! তাহলে ‘পরশপাথর’ কোথায় যাবে? কোথায় যাবে স্টার থিয়েটারে অভিনয় করা একের পর এক নাটকগুলি? আর ‘জনক নন্দিনী’? তিরিশের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটিতে সীতার বাবা রাজা জনকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তুলসীবাবু। এতটুকুও কৌতুক নেই; অদ্ভুত রাজকীয় ব্যক্তিত্ব ফুটে বেরিয়েছিল তাঁর মধ্যে। অবশ্য তাঁকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘অভিনয়ের ব্যাপারটা আমি বাপু তেমন বুঝি-টুঝি না।… খাতায় যা লেখা থাকে, স্টেজে দাঁড়িয়ে সেগুলোই গড়গড় করে পড়ে যাই।’
শুধু সেগুলোই পড়তেন না; দেখতেন নিজের চারপাশটাকেও। সমাজে যে সব মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে সব চরিত্র। আর ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। রীতিমতো নাড়া বেঁধে তাঁর কাছে অভিনয়ের খুঁটিনাটি শিখেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। একবার স্টারে নাটকের রিহার্সাল চলছে। অপরেশবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে তুলসী। একটা সামান্য ডায়লগ, সেটাকে বলছেন চেঁচিয়ে বলতে। অথচ চেঁচানোর মতো কিছুই পাননি তিনি। ফিসফিস করে ‘স্যার’কে জিজ্ঞেস করলেন, এত জোরে বলার দরকার আছে কি!
আরও পড়ুন
প্রয়াত বর্ষীয়ান অভিনেতা মনু মুখোপাধ্যায়, এক বিচিত্র অভিনয়-জীবনের সমাপ্তি
সবাই চুপ। অপরেশবাবুও চুপ। থিয়েটারে অপরেশ মুখুজ্জেকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলার সাহস কেউ দেখান না। আর এই ছোঁড়া কিনা…। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অপরেশবাবু বললেন আর রিহার্সাল দিতে হবে না। এই রে! বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন তুলসী চক্রবর্তী, এবার? পরে অবশ্য ছাত্রের এমন কথায় খুশিই হয়েছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু থিয়েটারেরও তো নিয়ম আছে; শেষ রো পর্যন্ত শব্দ না পৌঁছলে যে অভিনেতারই অসম্মান হয়।
এরকম নানা মুহূর্তের সঙ্গী তুলসী চক্রবর্তী। বাংলা সিনেমা তাঁকে কতটা ব্যবহার করতে পারল, তাঁর অতি দৈন্য অবস্থা— এসব নিয়ে তো হরদম তর্ক চলে। কফির টেবিলে তুফান ওঠে। সেসব না হয় একটু সরে থাক। মৃত্যুর এত বছর পরেও, মানুষটার কাজকে যদি সম্মান করা যায়, সেটাই তো ভালো। তুলসী চক্রবর্তীদের মতো অবস্থা যাতে আর কারোর না হয়, সেই চেষ্টাই না হয় করি। ‘পরশপাথর’ না খুঁজে, আসল হিরে খুঁজে বের করে আনি।
তথ্যসূত্র- ‘সাতরং’ প্রথম খণ্ড/ রবি বসু
আরও পড়ুন
প্রমথেশ বড়ুয়াই প্রকৃত ‘দেবদাস’, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উত্তমকুমার
Powered by Froala Editor