Powered by Froala Editor
ফিরে দেখা ২০২০ : চলে গেলেন যেসব স্বনামধন্য বাঙালি (দ্বিতীয় পর্ব)
১/১৮
শেষ হচ্ছে আরও একটি বছর। শেষ হচ্ছে ২০২০। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই একটি বছরেই আমরা হারিয়েছি বহু মানুষকে। করোনা অতিমারি সেই মৃত্যু মিছিলকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। ২০২০ সাল দেখেছে অসংখ্য বাঙালি কিংবদন্তি, শিল্পীর চলে যাওয়া। বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ-ইতিহাসে তাঁদের অবদান আমরা কোনদিনই অস্বীকার করতে পারব না। সশরীরে হয়তো নেই; কিন্তু তাঁদের কাজ আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। প্রহরের পাতায় থাকল সেইসব বাঙালিদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা –
২/১৮
অমলা শঙ্কর (২৪ জুলাই) বাংলা তো বটেই, ভারতের নৃত্য জগতের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ১১ বছর বয়সে প্যারিসে গিয়ে আলাপ উদয় শঙ্কর এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে। সেই থেকে শুরু উদয়-অমলার পথ চলা। দুজনে মিলে ভারতের সংস্কৃতি, ক্লাসিকাল নাচের ঘরানাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছিলেন। উদয় শঙ্করের পাশাপাশি অমলা শঙ্করও গোটা বিশ্বের আঙিনায় এক মুখ হয়ে ওঠেন। ১০১ বছর বয়সের দীর্ঘ একটি জীবনের মৃত্যু যেন এক যুগের অবসান।
৩/১৮
বিজয়া মুখোপাধ্যায় (২৮ জুলাই) আধুনিক কবিতার জগতে হাতে গোনা নারীদের মধ্যে বিজয়া মুখোপাধ্যায় প্রথম সারির একজন কবি। ‘ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম’, ‘দাঁড়াও তর্জনী’-র মতো কাব্যগ্রন্থে তাঁর ভাষার ব্যবহার অবাক করে। আবার সংস্কৃত সাহিত্যের গবেষক হিসাবেও কিংবদন্তি বিজয়া মুখোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসু ‘মহাভারতের কথা’ লেখার আগে তাঁর কাছেই সংস্কৃত শিখেছিলেন। ‘বিভাষা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গড়িয়াহাটের বাড়িতে শরৎকুমার ও বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের সংসার ছিল কবিতা দিয়ে সাজানো।
৪/১৮
সোমেন মিত্র (৩০ জুলাই) বাংলা রাজনীতির ‘ছোড়দা’ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। যৌবন থেকেই হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির পরিচিত মুখ। ১৯৭২-এ শিয়ালদহ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবার কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বিধায়ক হন। ২০০৬ সাল অবধি তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারেনি কেউ। একাধিকবার দলবদল করলেও, সোমেন মিত্রের ক্যারিশমা কিন্তু কমেনি এতটুকুও। ২০১৪ সালে আবার পুরনো দল কংগ্রেসে ফিরে আসেন তিনি। তখন থেকেই আমৃত্যু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন বাঙালির ‘ছোড়দা’...
৫/১৮
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (৪ আগস্ট) বাংলার অনুবাদ সাহিত্যের কথা উঠলে এই মানুষটি আসবেন না, তা হয় না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর হাত ধরেই ছাত্রছাত্রীরা শিখেছেন একটি লেখাকে কীভাবে বুঝতে হয়, কীভাবে পড়তে হয়। গাব্রিয়েল মার্কেজ, জুল ভার্ন, এডগার অ্যালেন পো প্রমুখ সাহিত্যিকদের লেখা অনুবাদ করেছেন। নিজেও লিখেছেন অনেক বই। আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে; কিন্তু করোনা সেসব স্তব্ধ করে দিল।
৬/১৮
শ্যামল চক্রবর্তী (৬ আগস্ট) তাঁর পরিচয় একজন দৃঢ়, দক্ষ বামপন্থী নেতা হিসেবে। ছাত্র রাজনীতি থেকে শ্রমিক আন্দোলন— সমস্ত জায়গায় মানুষের ভরসার মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বয়স বেড়ে গেলেও, কাজ থামাননি তিনি। বামফ্রন্টের মুখ বলতে যাঁদের বোঝায়, সেখানে প্রথম সারিতেই থাকবেন শ্যামল চক্রবর্তী। করোনা সংক্রমণ তাঁর বৃদ্ধ শরীরকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছিল। তবুও লড়াই করে গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। শেষমেশ, আগস্টেই নেমে এল দুঃসংবাদ। করোনা এসে কেড়ে নিয়ে গেল শ্যামল চক্রবর্তীকে।
৭/১৮
প্রণব মুখোপাধ্যায় (৩১ আগস্ট) বাংলা তো বটেই, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিঃসন্দেহে ইন্দ্রপতন। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর একে একে শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী— নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে দেশের ত্রয়োদশ এবং প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে বসেন তিনি। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বিশ্বের পাঁচজন শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীদের একজন বলে বিবেচিত করা হয়। তাঁর মৃত্যু নিঃসন্দেহে বড়ো ক্ষতি…
৮/১৮
শর্বরী দত্ত (১৮ সেপ্টেম্বর) খবরটা যখন এসেছিল, সবাই যেন থমকে গিয়েছিল। বাড়ির শৌচাগার থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্ত-কে। কবি অজিত দত্তের সন্তান হিসেবে থেমে থাকেননি; বরং নিজের কাজ দিয়েই গোটা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। ফ্যাশন দুনিয়ার চিরাচরিত পাশ্চাত্য প্রভাব থেকে টেনে আনেন বাংলাকে। শর্বরী দত্তের পোশাক মানেই আধুনিক রূপে হাজির হয় বাঙালিয়ানা। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আজও অনেকে মেনে নিতে পারেন না।
৯/১৮
পূর্বা দাম (১৯ সেপ্টেম্বর) দিনটি ছিল সুচিত্রা মিত্রের প্রয়াণদিবস। আর সেদিনই চলে গেলেন তাঁরই ছাত্রী, আরেক কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পূর্বা দাম। সুচিত্রা মিত্রের গানের ধারা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশুদ্ধ আবহকে সবসময় লালিত করেছেন অন্তরে। ২০১৩ সালে ‘সঙ্গীত সম্মান’ পেয়েছিলেন; সঙ্গে ছিল আপামর সঙ্গীতপ্রেমীর শ্রদ্ধা। বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই বছরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
১০/১৮
পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (২৯ সেপ্টেম্বর) সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলা সাহিত্যমহলে উঠে আসে একটি নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘দেবী’। আর এই বইটির মাধ্যমেই যাত্রা শুরু হয় পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের। বাংলা সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠকমাত্রেই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তে পড়তেই কবিতা প্রকাশ শুরু। “স্বপ্নের মতো আয়ু চলে যায় কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিত”— ৭১ বছর বয়সে সেই স্বপ্নের কোলেই আশ্রয় নিলেন কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। রেখে গেলেন সেইসব কবিতা, যা বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক বিশুদ্ধ হাওয়া…
১১/১৮
শক্তি ঠাকুর (৫ অক্টোবর) দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। তবুও গানে, গল্পে বেঁচেছিলেন প্রবলভাবে। কিন্তু, জোরালো হার্ট অ্যাটাক কেড়ে নিল প্রাণ। শক্তি ঠাকুর মানেই অভিনয়, এবং সেই সঙ্গে অনবদ্য সব গান। কিন্তু প্রতিভাধর এই শিল্পী সেভাবে খ্যাতি পাননি। তা নিয়ে আক্ষেপও ছিল না তাঁর। নিজের মতো করে থাকতেন; আর দেখতেন মেয়ে মোনালি ঠাকুরের খ্যাতি। সেরিব্রাল স্ট্রোক হলেও নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিলেন সবটা। কিন্তু, এই ২০২০ সেই পর্বে দাঁড়ি টানল…
১২/১৮
প্রদীপ ঘোষ (১৬ অক্টোবর) বাংলার বাচিকশিল্পের জগতে যে সমস্ত কিংবদন্তিরা পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রদীপ ঘোষ। কাজী সব্যসাচীর খ্যাতির মাঝখানেই আগমন তাঁর। তারপর দীর্ঘ জীবনে তাঁর গলা প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য কবির লেখনীতে। সাধারণ গলাকেও কী করে অসাধারণ জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, তা ওঁকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। করোনার অতিমারি নিঃশব্দে কখন যে আঘাত করে গেছে তাঁকে, ধরতে পারেননি। কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। সেই ভাইরাসের হাতেই থেমে গেল প্রদীপবাবুর আবৃত্তি…
১৩/১৮
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ নভেম্বর) একটাই শব্দ— ইন্দ্রপতন। একটি যুগের অবসান। বাংলার সংস্কৃতি জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই যেন একটি প্রতিষ্ঠান। বৃদ্ধ বয়সেও সমান তালে অভিনয় করে যাচ্ছিলেন মঞ্চে, সিনেমায়। রাজা লিয়রের দাপট দেখেছে বাঙালি। সবাই ভেবেছিল, করোনার লড়াইকে জয় করে ঠিক ফিরে আসবেন ‘ফেলুদা’। কিন্তু, সব চেষ্টা বৃথা। কলকাতার রাস্তা দেখল জনপ্লাবন। কলকাতা দেখল আরও এক মহানায়কের অন্তিম যাত্রা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ কি আজও মানতে পারি আমরা?
১৪/১৮
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (১৭ নভেম্বর) মাত্র দুদিন আগে চলে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালির শোকের রেশ তখনও শেষ হয়নি। তার মধ্যে আরও এক ইন্দ্রপতন। সুদূর জার্মানিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। শান্তিনিকেতনের পড়াশোনা তাঁর ভেতরের সৃষ্টিকে জাগিয়ে দিচ্ছিল। পরবর্তীকালে যোগ দিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা থেকে জার্মানি— অলোকরঞ্জন যেন আন্তর্জাতিক কবি হয়ে উঠলেন একটা সময়। সাহিত্য অকাদেমি, রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, গ্যোটে পুরস্কার— সম্মানের ঝুলি প্রচুর। তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের এক যুগকে থামিয়ে দিল।
১৫/১৮
মনু মুখোপাধ্যায় (৬ ডিসেম্বর) আগের মাসেই চলে গেছেন ‘ফেলুদা’ সৌমিত্র। বছরের শেষ লগ্নে এসে দাঁড়ি টানলেন ‘মছলি বাবা’ও। মনু মুখোপাধ্যায় যোগ্য সম্মান পেয়েছেন কিনা, তাঁর প্রতিভার সঠিক ব্যবহার হয়েছে কিনা সেসব আলাদা প্রশ্ন। সিনেমা, নাটক থেকে টেলিভিশন— সব জায়গায় তাঁর অভিনয় নজর কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ‘পাতালঘর’-এ তাঁর কাজ আজও সবার মনে। মৃণাল সেনের হাত ধরে সিনেমায় নামা, বাকিটা এক ইতিহাস। ৯০ বছর বয়সে জীবনের ক্রিজ থেকে বিদায় নিলেন মনু মুখোপাধ্যায়।
১৬/১৮
নাসের হোসেন (৯ ডিসেম্বর) সত্তরের দশক থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই কবির। ধীরে ধীরে কবিতার এক নিজস্ব স্বরের জন্য বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পেলেন নাসের হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ছিলেন কবিতাপাক্ষিক পত্রিকার সঙ্গে। নাসের হোসেনের কবিতা বিশ্বের বেশ কিছু ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকা ছিল অন্যতম নেশা। তাঁর আঁকা ছবির প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং মকবুল ফিদা হুসেন। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু ডিসেম্বরের গোড়ায় তাঁকে কাজে ফিরতে দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলেন সকলে। সেই আশ্বাস যে এমন হাহাকারে পরিণত হবে, কে জানত!
১৭/১৮
সুধীর চক্রবর্তী (১৫ ডিসেম্বর) তিনি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, গদ্যকার, অধ্যাপক… আরও কত কি। বাংলা সাহিত্যের এক অভিভাবক বলা চলে সুধীর চক্রবর্তীকে। বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পের ধারাকে তিনি বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন। ‘বাউল ফকির কথা’ এনে দেয় সাহিত্য অকাদেমি ও আনন্দ পুরস্কার। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সতেজ থেকেছেন, কাজের মধ্যে থেকেছেন। ২০২০-র শেষলগ্নে তিনিও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
১৮/১৮
জগন্নাথ গুহ (২২ ডিসেম্বর) একেবারে শেষ লগ্নেও মৃত্যু ছাড়ল না বাংলার সংস্কৃতি জগতকে। চলে গেলেন বাংলা সিনেমার অন্যতম প্রতিভাবান, জাতীয় পুরস্কার জয়ী প্রবীণ পরিচালক জগন্নাথ গুহ। তবে পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয় ও বাচিক শিল্পেও নিজের ছাপ রেখেছিলেন তিনি। একটা সময় সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের ডিন হয়েছিলেন। তাঁরই হাত ধরে তৈরি হয় শর্ট ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশন। করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেরে উঠেছিলেন দ্রুত। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ৭০ বছর বয়সে এসে জীবনের খাতায় দাঁড়ি পড়ল তাঁর।