Powered by Froala Editor
স্বাগত ২০২১ : চলতি বছরে শতবর্ষ পূর্ণ করবেন যেসব খ্যাতনামা বাঙালি
১/১৩
আবারও একটা নতুন বছরে পা দিল পৃথিবী। উল্টে গেল পুরনো ক্যালেন্ডারের শেষ পাতা। পড়ে রইল কিছু স্মৃতি, কিছু দুঃস্বপ্ন। নতুন বছরও কিছু স্মৃতি উস্কে দিয়ে যাচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে বেশ কিছু মানুষের কথা। এবছর যাঁরা শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। এমনই বেশ কিছু বাঙালির হাত ধরে আমরা একটা ইতিহাসের শরীক হয়ে উঠেছি। চিনতে শিখেছি আমাদের সংস্কৃতি তথা জাতিসত্ত্বাকে। তেমনই কিছু মানুষের কথা দেখে নেওয়া যাক।
২/১৩
শিবনারায়ণ রায় (২০ জানুয়ারি, ১৯২১ - ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮) বিশ শতকের যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবাদপুরুষ তিনি। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতাবর্ষে বিশ্বাসী ছিলেন আজীবন। বোম্বেতে ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপনা দিয়ে পেশাজীবনের শুরু। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে যান ভারততত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে। ফিরে এসে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতার র্যা ডিক্যাল হিউম্যানিস্ট সংস্থার প্রাণপুরুষ ছিলেন শিবনারায়ণ রায়।
৩/১৩
আহমদ শরীফ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ - ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) মধ্যযুগের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস অনুসন্ধানই তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে। অথচ তাঁর নানা প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ তুলে ধরেছে বিচিত্র বিষয়। বাংলার সমাজ, রাজনীতি এবং মানুষকে দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে। তেমনই বর্ণময় তাঁর জীবন। ব্রিটিশ সরকারের দুর্নীতি দমন শাখায় চাকরি নিয়ে পেশাপ্রবেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৈতিক কারণেই সেই চাকরি ছাড়তে হল। শুরু করলেন অধ্যাপনা। কাজ করেছেন ঢাকা রেডিও কেন্দ্রেও। আর এসবের মধ্যেই চালিয়ে গিয়েছেন গবেষণার কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নবরূপায়নেও তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
৪/১৩
সত্যজিৎ রায় (২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২) বাংলা সিনেমাও যে আন্তর্জাতিক হতে পারে, প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। পরিবারের সকলেই কিংবদন্তি। তিনিও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বহু পরিশ্রমে ‘পথের পাঁচালি’ তৈরি করে নজর কেড়েছিলেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের সিনেমার গত ভেঙেছেন নিজেই। বাংলায় উপহার দিয়েছেন প্রথম মিউজিক্যাল সিনেমা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। আবার শর্ট ফিল্মেও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। পেয়েছেন অস্কার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার। তেমনই সমানে এগিয়ে চলেছে তাঁর কলম। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর মতো চরিত্র যেমন উপহার দিয়েছেন, তেমনই অসংখ্য ছোটোগল্পে তুলে এনেছেন মনঃস্তাত্বিক জটিলতা। মূলত শিশুতোষ সাহিত্য হলেও তাঁর লেখা যেন বেশি কিছু বলে।
৫/১৩
সুকুমারী ভট্টাচার্য (১২ জুলাই ১৯২১ - ২৪ মে ২০১৪) ভারতীয় ইতিহাস ও সাহিত্যের বিদগ্ধ পণ্ডিত তিনি। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় একাধিক প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন প্রাচীন ভারতের প্রকৃত ছবি। দর্শনের মধ্যে নানা টানাপোড়েনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা থেকে। আবার তেমনই প্রাচীন সমাজে নারীদের অবস্থান নিয়ে তাঁর আলোচনা আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। মাইকেল মধুসূদনের পরিবারে জন্ম তাঁর। সেই মুক্তচিন্তার প্রভাব থেকে গিয়েছে সারা জীবন।
৬/১৩
রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (২১ আগস্ট ১৯২১ – ১৮ মার্চ ২০০৯) বাংলার পুরাতনী ও ভক্তিগীতির ধারায় খুব কম শিল্পীই জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁদের মধ্যেই অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আন্তরিক অনুভূতির প্রকাশ শ্রোতাকে মুগ্ধ করে বসিয়ে রাখতে জানত। চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজও করেছেন। আবার পুরাতনী গানের ধারাতেই সমকালের ছাপকে তুলে ধরেছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।
৭/১৩
বিমল কর (১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১ - ২৬ আগস্ট ২০০৩) বাঙালি পাঠকদের কাছে তাঁর পরিচয় নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের তালিকায় তাঁর নাম থাকবে প্রথমের দিকেই। গোয়েন্দা কিকিরা তো আনন্দমেলার প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। বড়োদের জন্যও লিখেছেন একাধিক কৌতুক উপন্যাস। আবার সামাজিক জটিলতা নিয়েও বিশ্লেষণী হয়ে উঠেছে তাঁর কলম। দেশ পত্রিকার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন দীর্ঘকাল। এছাড়াও সত্যযুগ, পশ্চিমবঙ্গ, শিলাদিত্য এবং গল্পপত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিমল কর।
৮/১৩
নীলিমা ইব্রাহিম (১১ অক্টোবর ১৯২১ — ১৮ জুন ২০০২) বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঙালি সমাজের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে চোখে পড়েছিল। আর সেই নারীদের মধ্যেই অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম নিলীমা ইব্রাহিম। মূলত শিক্ষাবিদ হিসাবেই তাঁর পরিচিতি। নারীশিক্ষার পাশাপাশি গ্রামেগঞ্জে সকলের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার এক অক্লান্ত কর্মী ছিলেন তিনি। পাশাপাশি চলেছে সাহিত্যচর্চা। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘যে অরণ্যে আলো নেই’ এক কিংবদন্তি দৃষ্টি। পরবর্তীকালে এই উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল জনপ্রিয় নাটক। বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, একুশে পদক সহ দেশবিদেশের নানা সম্মান পেয়েছেন তিনি।
৯/১৩
সুবিনয় রায় (৮ নভেম্বর, ১৯২১ - ৯ জানুয়ারি, ২০০৪) গণিত শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করা মানুষটিকে সকলেই একডাকে চেনেন সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে। তাঁর কণ্ঠে একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে শিক্ষক হিসাবে প্রথমে যোগ দিলেও পরে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে কাজ করতে করতেই পঙ্কজ মল্লিকের কাছে নতুন করে সঙ্গীতশিক্ষার শুরু। তাঁকেই শিক্ষাগুরু মনে করে এসেছেন সারা জীবন। আকাশবাণী বেতারকেন্দ্রে শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ। এরপর একের পর এক রেকর্ডে তাঁর গান বাঙালিকে মুগ্ধ করেছে।
১০/১৩
চিদানন্দ দাশগুপ্ত (২০ নভেম্বর ১৯২১ - ২২ মে, ২০১১) সাতটি আন্তর্জাতিক সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রখ্যাত সমালোচক। সিনেমা বিষয়ক তাঁর একাধিক গ্রন্থ শিল্পীদের কাছে অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত। কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। মেয়ে অপর্ণা সেনও বাবার হাত ধরেই সিনেমার জগতে পা রেখেছেন। এছাড়াও অনুবাদক হিসাবে তাঁর ভূমিকা ভোলার নয়। জীবনান্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির ইংরেজি তর্জমায় সাহিত্যকৃতির এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখেছেন তিনি।
১১/১৩
ড. হীরালাল চৌধুরী (২১ নভেম্বর ১৯২১ - ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪) প্রয়োগমূলক বিজ্ঞানে তিনি একজন পথিকৃৎ। তাঁর আবিষ্কৃত কার্প জাতীয় মাছের প্রণোদিত প্রজননের পদ্ধতি মাছ চাষে বিপ্লব ঘটয়ে দিয়েছিল। সিলেটের মুরিচাঁদ কলেজে কর্মজীবন শুরু হলেও দেশভাগের পর চলে আসেন ভারতে। জাতিপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের উপদেষ্টা হিসাবে নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে। তিনি পুকুরে মিশ্রচাষের পদ্ধতিরও জনক।
১২/১৩
ননী ভৌমিক (১৯২১ — ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৬) অত্যন্ত অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে। ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে ৪৬-এর দাঙ্গা এবং তেভাগা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামেগঞ্জে। সেইসব অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই সাহিত্যচর্চার শুরু। ‘অরণি’ ও ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। রাশিয়ার ‘প্রোগ্রেস পাবলিকেশন’-এর সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিক অনুবাদকের কাজ নিয়ে চলে যান মস্কো। তাঁর অনুবাদে ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’, ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’-এর সূত্রেই রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পরিচয় হয় বহু বাঙালির।
১৩/১৩
কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর ১৯২১ - ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) সারা বিশ্বে জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী হলেও তিনি নিজেকে পটুয়া বলতেন। এই শব্দটির সঙ্গে যে একটা বাঙালিয়ানা জড়িয়ে আছে। কলকাতায় জন্ম এবং আদি নিবাস বর্ধমানে, তবে দেশভাগের পর ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই চিত্রশিল্পের বিকাশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াহিদা রহমানের মুখ এঁকে তৈরি পোস্টার তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকারও রূপকার তিনি।