প্রেম নিবেদনের কয়েকদিন পরেই ফাঁসি, ১০ বছর ‘ফিরে আসা’র অপেক্ষায় ছিলেন কল্পনা

সালটা ১৯৩৩। নাক টানলে বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের সূর্য প্রায় ঢলেই পড়েছে। বিচার চলাকালীন শাসকের বিচারসভায় একদিন এক টুকরো বিষণ্ণ নিবেদন - “তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি?”

তাঁর 'ফুটুদা'র কথা না লিখে পারেননি কল্পনা দত্ত -
‘‘ধরা পড়ার পর মাস্টারদা, ফুটুদা আর আমাকে নিয়ে নতুন করে মামলা শুরু হয়েছিল। আমরা কাঠগড়ায় একসঙ্গে দাঁড়াতাম। সেইসময় একদিন ফুটুদা বলেছিলেন, তোকে ভালো লাগে। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি? আমার মৌনতায় হয়তো সম্মতি ছিল।'' (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা -কল্পনা দত্ত)

১.
১৯১৩-র ২৭ জুলাই জন্মানো কল্পনা দত্ত ছোটো থেকেই ছিলেন স্বপ্নবিলাসী, স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ সমাজের। অন্যান্য সাধারণ বাঙালি মহিলাদের চেয়ে বেশ খানিক লম্বা, ছিপছিপে গড়নের, সুন্দরী, ঋজুদেহ, বলিষ্ঠ, কাঁচা হলুদ গায়ের রঙের সঙ্গে কল্পনার ছিল ভীষণ মিষ্টি এক হাসি।

স্বাধীনতা আন্দোলন আর বিপ্লবীদের সম্পর্কে তাঁর আকর্ষণ আর শ্রদ্ধা ক্রমশ বেড়েই চলে। বেথুন কলেজে ঢুকে নিলেন সায়েন্স। কল্যাণী দাসের বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্রী সংঘে যোগ দিলেন। পাকেচক্রে হয়ে গেলেন মাস্টারদার প্রিয় পাত্রী, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’। বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ঘটনায় সূর্য সেন এবং তাঁর নারী সৈনিক হিসেবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল কল্পনা দত্তর নামও।

স্কলারশিপের টাকায় কিনে ফেললেন সাইকেল। কাকভোরে উঠে কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেলে ঘুরপাক খেতেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে শুরু করলেন নৌকা চালানোর অভ্যাস যেহেতু তিনি সায়েন্সের, তাই সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মির জন্য নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।

তারপর সাড়া ফেলে দিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ঘটনা।

১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল আর ২২শে এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় কল্পনা এতটাই অনুপ্রাণিত হলেন যে, ছুটিতে চট্টগ্রাম এসে তাঁর আর কলকাতায় ফেরা হল না। তখনও মাস্টারদার সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ বা কথা হয়নি। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের পর অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও লোকনাথ বল আরও অনেকেই গ্রেফতার হন। মাস্টারদা চলে যান আত্মগোপনে।

১৯৩২-এ পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে শহীদ হন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। পুরুষবেশী কল্পনা ধরা পড়ে গিয়ে আবার আত্নগোপন করেন।

'৩৩ এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গী ছিলেন কল্পনা। মাস্টারদা আর ব্রজেন সেন পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কল্পনা পালিয়ে যান। কিন্তু তিন মাস পর ১৯ মে গৈরালা গ্রামে এক সশস্ত্র সংঘর্ষের পর কল্পনা সহ তাঁর সতীর্থ বিপ্লবীরা ধরা পড়েন।

প্রায় ৬ বছর কারাভোগের পর, ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান। মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর বাবা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন। হারালেন বাড়িটাও।

২.
তারকেশ্বর দস্তিদার চট্টগ্রামের সারোয়াতলীর চন্দ্রমোহন দস্তিদারের ছেলে। তারকেশ্বরকে সাথীরা ডাকতেন 'ফুটুদা' নামে।

চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে তারকেশ্বর দস্তিদারের স্থান ছিল সপ্তম। বিদ্রোহের এক মাস আগে পাহাড়তলীতে লুকিয়ে ১৭টা বোমার জন্য পিক্‌রিক পাউডার তৈরির সময় ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে তিনি মারাত্মক আহত হন। হয়তো বাঁচতেনই না, বুক, হাত, মুখ পুড়ে গেছিল। শরীরের নানা অংশের হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে। ঐ অবস্থায় কাতর কণ্ঠে অনন্ত সিংহকে বলেছিলেন, 'আপনি আমাকে গুলি করে মেরে সংগঠনকে বাঁচান।' কিন্তু মাস্টারদার নির্দেশে তাঁকে গোপনে গ্রামে পাঠিয়ে, চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন সবাই মিলে। ডি-ডে তে আর অংশ নিতে পারেননি বিপ্লবী তারকেশ্বর। কিন্তু সামান্য সুস্থ হয়ে গ্রামে পার্টি-সংগঠনের দায়িত্বভার তুলে নেন।

১৯৩০-৩১ সালে ডিনামাইট আর ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ করে বন্দি মুক্তি আর ব্রিটিশ প্রশাসন অচল করার উদ্যোগে তারকেশ্বরের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ল্যান্ডমাইন তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণে গানকটন তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন।

জালালাবাদ যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। সবাই যখন ছত্রভঙ্গ, দলের হাল ধরলেন তারকেশ্বর। আহত অবস্থাতেও পলাতক সঙ্গীদের জন্য ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা করতে লাগলেন নিরাপদ আশ্রয়ের। মাস্টারদা তখন কানুনগো পাড়ার এমনই এক আশ্রয়ে, দারোগা শশাঙ্ক সেই আস্তানা জেনে ফেলায় তাকে গুলি করে মারেন তারকেশ্বর।

কিন্তু ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে ধরা পড়ে গেলেন মাস্টারদা। বন্দি করে তাঁকে আনা হল চট্টগ্রাম জেলে। দলের হাল ধরলেন সেই ডাকাবুকো তারকেশ্বর। সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, মাস্টারদাকে জেল থেকে বের করে আনতেই হবে। কৌশল খাটাতে লাগলেন জেলের ভেতর। টাকা দিয়ে ওয়ার্ডারদের বশ করে অচিরেই জেলে পৌঁছে গেল বিস্ফোরক, রিভলভার, সেলের তালা খোলার জন্য ডুপ্লিকেট চাবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে গেলেন এই কাজে থাকা শৈলেশ রায়। ফাঁস হয়ে গেল সবকিছু, পুলিশের নজরে চলে এলেন তারকেশ্বর দস্তিদারও।

১৯৩৩-এর ১৯শে মে গহিরা গ্রামে পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে গোপন মিটিং-এ গেলেন ফেরার তারকেশ্বর। সেখানে আছেন মনোরঞ্জন দাস, কল্পনা দত্ত সহ আরও অনেক পলাতক বিপ্লবী। গোপন সূত্রে খবর, পেয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলল পুলিশ। শুরু হল গুলির লড়াই। কিন্তু রিভলভার আর কতক্ষণ চালানো যায়? নিহত হলেন মনোরঞ্জন, গৃহস্বামী পূর্ণ আর তাঁর ভাই নিশি তালুকদার। ধরা পড়লেন কল্পনা, তারকেশ্বর সহ বাকি বিপ্লবীরা। ধরা পড়ার পর, মেজর কিম তারকেশ্বর দস্তিদারকে বুট জুতা পরা পা দিয়ে মারলেন সপাটে এক লাথি।

চোখের ভেতর থেকে পিচকিরির মতো বেরোতে থাকে রক্ত।

তারপর অনেকদূর গড়িয়ে গেল জল। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, সি.এফ অ্যান্ড্রুজ কল্পনার বাবাকে কথা দিলেন, তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

১৯৩৯ সালের ১লা মে আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কল্পনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। জেলে বসে কল্পনা কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কিছু কিছু শুনেছিলেন। জায়াড, কোলে, বার্নাড শ'র লেখা, সোশ্যালিজম, কমিউনিজম নিয়ে বইও পড়ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কমিউনিস্টরা অনেক বেশি শিক্ষিত, পড়াশোনা করে, জানে অনেক বেশি। রম্যাঁ রল্যাঁর ‘আই উইল নট রেস্ট’ পড়লেন, 'সোল এনচান্টেড' আর ‘জা ক্রিস্তোফ’ পড়ে শুরু করলেন লেনিন পুজো।

'৪০-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পরীক্ষা দেন। সেই বছরই মুম্বাইতে এক সম্মেলনে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে সেখানেই পি. সি যোশীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৪ সালে যোশীকেই বিয়ে করেন কল্পনা। পি. সি যোশী তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভেঙে গেল। ভারতে চলে এলেন কল্পনা। ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রতিদিনের কাজে রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে নাম করলেন। '৫০ এর পরে নিউ দিল্লির রুশ ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন।

আর সেই ‘ফুটুদা’? সেই কথা কল্পনা দত্ত স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন - ‘‘দুর্ভিক্ষের পরে বোম্বেতে একটা কনফারেন্স হয়েছিল। সালটা সম্ভবত ১৯৪৩। আমি চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই জোশী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি বললাম আই হ্যাভ প্রমিসড্‌ তারকেশ্বর দস্তিদার। জোশী বলল, তুমি জানো না ওর ফাঁসি হয়ে গেছে। ও তো আর কোনদিন আসবে না। …তাও আমি দোনামোনা করছিলাম। বিটি(বিটি রণদিভে), ডক(ড: গঙ্গাধর অধিকারী) এরা ইনসিস্ট করাতে বিয়ে করলাম।’’

১৯৩৪-এ মাস্টারদার সঙ্গেই ফাঁসি হয়ে যায় তারকেশ্বর দস্তিদারেরও।

ফাঁসির আগে বিপ্লবীদের স্লোগানের মাঝেই বীভৎস অত্যাচার চালানো হয় মাস্টারদা আর তারকেশ্বরের ওপরে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দাঁত, নখ সব ভেঙে দেওয়া হয়। সমস্ত জয়েন্ট আর হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, আসলে আগেই মেরে ফেলে মৃতদেহকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown”-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরো বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়।

১৯৯৫-এর ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কল্পনা দত্ত বেঁচে ছিলেন। সব লড়াইয়ে ‘ফুটুদা’-র ঐতিহ্য, আত্মত্যাগের শিক্ষা তাঁর সঙ্গেই ছিল।

কল্পনার জীবনের আক্ষেপ ছিল, তিনি তিন হাজার পৃষ্ঠার আত্মজীবনী লিখেও সেটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু যেটুকু স্মৃতিকথা লিখে গেছেন, বিচারাধীন থাকার সময় তাঁর 'ফুটুদা'র দেওয়া নিরীহ প্রোপোজালের কথা তাতে রেখেছেন। আর সেই স্মৃতিকথাই জানান দেয় এক অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনির। দুই বিপ্লবীর না-হওয়া সম্পর্কের কথা। অথবা, এই অসম্পূর্ণতাই হয়তো মিলিয়ে দিয়েছে তাঁদের। অপেক্ষাই। হয়তো…

More From Author See More

Latest News See More