সালটা ১৯২১। বিলেত থেকে ঘুরে খুলনার গ্রামে বেড়াতে এলেন এক অধ্যাপক। কলকাতায় নামী কলেজে পড়াতেন তিনি। সারা ভারতে তাঁর নাম। এত বড়ো মানুষ, অথচ মনটা যে মাটির সঙ্গেই জুড়ে আছে। গ্রামে আসবেন না, তা কি হয়! কিন্তু এসে যা দেখলেন, সেটার কথা হয়ত কল্পনাও করেননি ওই অধ্যাপক। নিজের জন্মস্থান, খুলনার দিকে দিকে তখন হাহাকার। লোকজন মরে আছে ঘরে। জল, হাওয়া, খাবার— সবই যেন দূষিত। দুর্ভিক্ষ যেন গোটা জায়গাটিকে শ্মশান করে রেখেছে। তার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে ম্যালেরিয়া। কিন্তু খুলনার জেলা প্রশাসন থেকে কিছুই স্বীকার করা হচ্ছে না। এরম অবস্থাতেই এগিয়ে এলেন ওই মহান অধ্যাপক। গঠন করেন রিলিফ কমিটির। জোর কদমে চলতে লাগল কাজ। আগে মানুষ, তার জীবন, তারপরে বাকি সব। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আসল মন্ত্র তো ছিল এটাই।
তখনই তৈরি হল বেঙ্গল রিলিফ কমিটি। খুলনার মারাত্মক দুর্ভিক্ষে নেমে পড়েছিল এই দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন একজন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ঋষিতুল্য এই মানুষটির পরিচয় একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী হিসেবেই থেমে থাকে না। দেশীয় শিল্পেও যেমন দিশা দেখিয়েছিলেন, তেমনই মানুষের বিপদের সময় সমস্ত রকম ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। খুলনা দুর্ভিক্ষই একমাত্র নয়। একইরকম বিপদের মধ্যে পড়ে উত্তরবঙ্গ। তবে সেটার কারণ ছিল অন্য।
খুলনার দুর্ভিক্ষ পেরিয়েছে সবে এক বছর হল। ১৯২২ সালে আবারও একটা আবর্তে পড়ল বাংলা। সেপ্টেম্বরের প্রবল বৃষ্টিপাতে উত্তরবঙ্গের আত্রাই নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। অন্যান্য নদীও থেমে থাকল না। দেখা দিল প্রবল বন্যা। ব্রহ্মপুত্রের জল আত্রাই নদী হয়ে ভাসিয়ে দিল সব জায়গা। কিন্তু কলকাতায় এই খবর একটু দেরিতেই পৌঁছয়। কারণটি সহজেই অনুমেয়। তখনকার দিনে এত আধুনিক আয়োজন ছিল না। তার ওপর যে মেল ট্রেন দার্জিলিং থেকে ছেড়েছিল, তা পার্বতীপুরে এসে থেমে আছে। আগে লাইন ভেঙে গেছে। এখন উপায়? কোনোমতে সেখানকার রেল কর্মীদের বুদ্ধিতে একটি রাস্তা খুঁজে পেয়ে তাঁরা চলে আসেন কলকাতা। তখন প্রথম খবরে ছাপল এই ভয়ংকর দুর্যোগের কথা।
ভারত সভা হলে আয়োজিত হল জনসভা। তৈরি হল বন্যা সাহায্য কমিটি। কাজে নামল বেঙ্গল রিলিফ কমিটিও। প্রফুল্লচন্দ্র এবার আর দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। পরোক্ষে থেকে সমস্ত নজরে রাখবেন, এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু সেটা হল না। কমিটির সভাপতি’র আসনে বসলেন তিনি। অবশ্য এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও একজন। এই ব্যক্তিটি জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। বয়সে তরুণ, কিন্তু অদ্ভুত তেজ আছে। তিনি এবার মাঠে নামলেন সবার সঙ্গে। যুবকটির নাম? সুভাষচন্দ্র বসু!
আরও পড়ুন
‘বিক্রি’-র পথে আরও ২৭ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, তালিকায় বেঙ্গল কেমিক্যালসও!
বিজ্ঞান কলেজে বন্যা সমিতির অফিস তৈরি করা হল। স্বেচ্ছাসেবক, সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক— সবার উপস্থিতিতে ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। সব জায়গায় সাহায্যের জন্য আবেদন করা হল। দেশের মানুষের কাছে তো বটেই, বিদেশেও। সুভাষচন্দ্র বসু নিজে চলে গেলেন উত্তরবঙ্গে। সংবাদের ভিত্তিতে নয়, সরেজমিনে নিজের চোখে দেখতে চান ব্যাপারটা। সেখানেও সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ই উঠে এল ক্ষতির পরিমাণের প্রসঙ্গও। সবাই বুঝতে পারলেন, সরকার থেকে যে অঙ্কটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা আসলে কিছুই না। আসল পরিস্থিতি তার থেকেও গুরুতর। একে তো রেললাইন, চাষের জমি সমস্ত ডুবে যায়। তৎকালীন স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী, শুধু বগুড়া জেলায় ক্ষতির পরিমাণ এক কোটির ওপরে! তালোরা গ্রামে যে ২০০টি বাড়ি ছিল, তার ৭টি মাত্র অবশিষ্ট আছে। পাবনা আর রাজশাহী জেলার মিলিত ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ কোটির ওপর। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ভেবেই আতঙ্ক আসে আজ!
আরও পড়ুন
স্বদেশি আন্দোলন, বেঙ্গল ইমিউনিটি ও ‘ক্যাপ্টেন’ নরেন্দ্রনাথ দত্তের গল্প
সুভাষচন্দ্র বসুর পর ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ বসুও এই কাজে এসেছিলেন। নিজে থেকেই অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটা তো আসলে মানুষকে, দেশকে বাঁচানোর লড়াই। ঠিক যে কাজটি এক বছর আগে খুলনাতে করেছেন সবাই। সুভাষচন্দ্র বসুও সমস্তটা দিয়ে লড়েছিলেন এই সময়। পরে এই বন্যার সমস্যার জন্য সরকারকেও দায়ী করেন অনেকে। অভিযোগ, উত্তরের ছোটো রেললাইনকে বড়ো করার ফলে নিকাশি ব্যবস্থায় আঘাত পড়ে। সেইজন্য আগেও বন্যা হয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেখানকার কর্মীরা সরকারকে বলেও; কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন তাতে বিন্দুমাত্র সাড়া দেননি। আর সেই সময়, বন্যা বা দুর্ভিক্ষ হলে, রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যেত। ভয় ছিল সেটারও। অথচ সরকার তথ্য চাপছে। আগেও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু সেসব দূরে রেখে, রিলিফ কমিটি ও বন্যা সাহায্য কমিটি যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, তা এক কথায় ছিল অভূতপূর্ব। আর এই সবকিছুর মূলে ছিলেন একজন মানুষ— আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আজকের এমন অবস্থাতেও তিনি নিশ্চয়ই থেমে থাকতেন না!
আরও পড়ুন
১২৮ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড বেঙ্গল কেমিক্যালের, এক দিনে উৎপাদিত ৫২ হাজার বোতল ফিনাইল
ঋণ- আত্মচরিত/ প্রফুল্লচন্দ্র রায়
Powered by Froala Editor