কাঁধে ঝোলানো অ্যাকোয়াস্টিক গিটার। আঙুলের ছোঁয়ায় সুরের ঢেউ খেলছে আর্পিজিয়োয়। মাইক্রোফোনের পিছনে দাঁড়িয়েই গেয়ে চলেছে কাঁধ অবধি চুলের মেয়েটা। শান্ত দুটো চোখের মধ্যে যেন সেই লাইনগুলোরই প্রতিফলন। যে লাইনগুলো তীরের মতো গিঁথে যাচ্ছে সামনের কয়েকশো মানুষের বুকে। একটা ঘোরের মধ্যেই গায়িকার সঙ্গে নিচু শব্দে গলা মিলিয়ে যাচ্ছেন শ্রোতারা। তাঁদের ভিতর আন্দোলিত হচ্ছে অপূর্ণ ভালোবাসার সমুদ্র।
১৯৬১ সাল। জোন বায়েজ নতুন করে শেখাচ্ছেন কান্ট্রি মিউজিক। শেখাচ্ছেন ফোকলোরের মানে। সেই সুরের গন্ধ কীভাবে জড়িয়ে যায় আফিমের মতো, দেখাচ্ছেন তিনি। তেমনই একটা সন্ধের কনসার্ট। মাদকতা কুড়োতেই জড়ো হয়েছে বহু মানুষ।
সেই ভিড়ের মধ্যেই মিশে আছে বছর কুড়ির এক যুবক। সেও গান বাঁধার চেষ্টা করে চলেছে নিত্যদিন। লিখতে চেষ্টা করছে নতুন দু’কলি উপাখ্যান। কিন্তু সেভাবে পৌঁছনো যাচ্ছে না কারোর কাছেই। তারও স্বপ্ন এমন মঞ্চে দাঁড়িয়ে, গিটার হাতে মানুষের চোখে জল এনে দেবে সে। সে জানে, এটা তাকে পারতেই হবে। আর সে যে পারবেও, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী সেই যুবক। কিন্তু কী আছে এই মেয়েটার গানে, কথায়, কণ্ঠে? কেন নতুন করে ‘কেয়ারলেস লাভ’ পাগল করে দিচ্ছে তাকে? আলাপ করবে সে নিজে গিয়ে?
আলাপ হল। বা তার থেকেও আরও বেশি কিছু। জোন বায়েজ ফোকলোরের সম্রাজ্ঞী বাস্তবে যে এতটাই সহজ জানা ছিল না তাঁর। স্বল্পদিনের পরিচয়েই জোয়ান বায়েজ একসঙ্গে কাজ করার আর্জি জানালেন সেই যুবককে। বব ডিলান। শুরু হল তাঁর সেই খ্যাতির চুড়োয় যাওয়ার পথ। একের পর এক গানের কথা লিখতে থাকলেন ডিলান। সুর আর কণ্ঠের দায়িত্ব নিলেন স্বয়ং সম্রাজ্ঞী।
সেই সময় বব ডিলান নিজেও চলেছেন এক ভাঙনের মধ্যে দিয়ে। সুজি রটোলো ফিরে গেছেন ইতালিতে। আর যুক্তরাষ্ট্রে এক নিসঙ্গতা গ্রাস করেছে তাঁকে। সবকিছুতেই যেন বিষ, সেসব দিনে। তবে জোন বায়েজ যেন নিশব্দেই দেখিয়ে দিলেন, গানেই মুক্তি তাঁর। গানই ঢেকে দেবে সমস্ত ক্ষতচিহ্ন। পিছনে না তাকিয়ে পথ দেখাবে সামনের দিকে। ডিলান লিখলেন ‘ডোন্ট থিংক টোয়াইস, ইট’স অল রাইট’ (১৯৬৩)। লিখলেন ‘আই শ্যাল বি ফ্রি’ (১৯৬৩)।
আরও পড়ুন
বিক্রি হয়ে গেল বব ডিলানের লেখা সমস্ত গানের স্বত্ব
তবে সত্যিই কী মুক্ত হলেন তিনি? না, বরং ততদিনে তিনি বাঁধা পড়ে গেছেন আরেক ভালোবাসায়। সেই যন্ত্রণা, কষ্ট, শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে ডিলান তখন ভেতর থেকে আঁকড়ে ধরেছেন জোন বায়েজকে। একই সঙ্গে মঞ্চ মাতাচ্ছেন তাঁরা। একই সঙ্গে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাফেগুলোয়। কনসার্ট। সে যেন এক রূপকথার সম্পর্ক। খবরের কাগজ জুড়ে পাতায় পাতায় তাঁদের নাম। চর্চা। ডিলান আর বায়েজের মধ্যেকার সেই রহস্যটা জানতেই মুখিয়ে সারা পৃথিবী। তবে তখনও প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি কেউই।
সে বছরই, ১৯৬৩ সালে ইতালি থেকে ফিরে এলেন সুজি। দেখলেন তাঁর সাজানো পৃথিবী বদলে গেছে অনেকটা। জোয়ান বায়েজের সঙ্গেই নতুন করে ঘর গুছিয়েছেন ডিলান। কিন্তু ইতালি যাওয়ার সময় কি সত্যিই ইতি টেনে গিয়েছিলেন তিনি? সে প্রশ্ন না করেই ডিলানের ফ্ল্যাটে থেকে যাওয়া সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন সুজি। বাসা বদল করে চলে গেলেন অন্য ফ্ল্যাটে। আর ডিলান গেয়ে উঠলেন, ‘আই ডোন্ট বিলিভ ইউ’। একটা অ্যালবাম যেন পাগল করে দিল মানুষকে। সুজির পরিচয় হয়ে দাঁড়াল বব ডিলানকে প্রত্যাখ্যান করা প্রাক্তন প্রেমিকা।
আরও পড়ুন
কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদ, দীর্ঘ আটবছর পর নতুন অ্যালবাম নিয়ে আসছেন বব ডিলান
তবে এসব গানের মধ্যেই চলতে থাকল প্রতিবাদী সুর। জোন বায়েজের হাত ধরেছেন যে তিনি। আর বায়েজ তাঁর মধ্যে ক্রমশ বুনে চলেছেন প্রতিবাদী এক মহীরুহের চারা। কিন্তু সেই চারাকে লালন করতে গেলে অংশ নিতে হবে রাজনীতিতে! খ্যাতি, খ্যাতি আরও খ্যাতি। খিদের মতোই তখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে ডিলানকে। আরও ওপরে পৌঁছতে হবে তাঁকে। আরও ওপরে। আর এভাবে প্রতিবাদে, মিছিলে, জমায়েতে গান গেয়ে তা কি সম্ভব? তাই লেখাতেই নিজেকে সীমিত রাখলেন ডিলান। ফলও পেলেন তার। প্রেমিকা জোয়ান বায়েজকেও ছাড়িয়ে গেলেন তিনি। জোন বায়াজের থেকে ডিলানের পরিচিতির পরিধি বাড়ল কয়েকগুণ।
তবে উপরে উঠতে উঠতেই হয়তো ছোটো হয়ে আসে দাঁড়ানোর জায়গা। খ্যাতিও তেমনই এক পাহাড়। যার শীর্ষে দাঁড়াতে গেলে পাশে আরেকজন জায়গা করে দেওয়াও দায় হয়ে পড়ে। হলও তেমনটাই। ধীরে ধীরে সম্পর্কের পরিধিও ছোটো হয়ে এল আরও। কমে এল প্রতিদিনের কথা বলাও। হবে নাই বা কেন? একদিকে মানুষের অধিকারের জন্য তখন অগ্নিকণ্ঠে সরব হচ্ছেন বায়েজ। তখনই অন্যদিকে ডিলান একা মঞ্চ মাতাচ্ছেন। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত মেরু যেন। যাঁদের মধ্যে কমে যাচ্ছে আকর্ষণ।
১৯৬৫ সাল। সেই ঐশ্বরিক উত্থানের সুবাদেই ব্রিটেনে গান করার ডাক পড়ল ডিলানের। সঙ্গে অবশ্য বায়েজও গেলেন সেখানে। আন্তর্জাতিক এক মঞ্চ। তাঁরও গান গাইবার কথা ডিলানের সঙ্গে। তবে ইংল্যান্ডে গিয়ে খানিকটা যেন বদলেই গেলেন ডিলান। অনুরাগীদের পেয়ে ভুলে গেলেন প্রেমিকার কথাই। যে প্রেমিকার হাত ধরেই একদিন গান বাঁধার তাগিদ ফিরে পেয়েছিলেন তিনি। নিজেকে যেন “এক্সট্রা ব্যাগেজ” বলেই মনে হতে লাগল বায়েজের। তাঁর বারণ সত্ত্বেও সেখানে ডিলান ডুবে গেলেন নেশায়।
আরও পড়ুন
বব ডিলানের ডাইরির একটি পাতার দাম ২২ লক্ষ ডলার, জেনে নিন কী আছে তাতে
তারপর সেই সন্ধে। মাদক, ড্রাগস, সিগারেট ছড়িয়ে রয়েছে সারা গ্রিনরুম জুড়ে। মঞ্চে ওঠার ডাক। গিটারের স্ট্র্যাপ কাঁধে গলিয়ে নিলেন ডিলান। মঞ্চে ওঠার কথা জোন বায়েজেরও। তবে বেঁকে বসলেন ডিলান। এই শো তাঁর একার। তাঁর সঙ্গে গান গাওয়ার কোনো অধিকার নেই বায়েজের। কুণ্ঠা বোধ না করেই জানিয়ে দিলেন ডিলান। ‘গো হোম’ শোনার পরে আর দাঁড়াননি ফোকলোর সম্রাজ্ঞী। সেই মঞ্চের দোরগোড়া থেকে, গ্রিনরুম থেকেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। দাঁড়ি টেনেছিলেন স্বপ্নের সেই সম্পর্কের উপাখ্যানে। বায়েজের জীবনের একটা অধ্যায়ে পর্দা পড়ল এভাবেই।
“লর্ড আম ওয়ান, লর্ড আম টু
লর্ড আম থ্রি, লর্ড আম ফোর
লর্ড আম ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস, আওয়ে ফ্রম হোম...”
১৯৬৫ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত অ্যালবামে সেই অভিমান, যন্ত্রণা থেকেই কি এই গান গেয়ে উঠলেন বায়েজ? জানা নেই। তবে এতকিছুর পরেও কোনো সংবাদ মাধ্যমেই মুখ খোলেননি তিনি। দোষারোপ করেননি বব ডিলানকে। নিভৃতে বেছে নিয়েছিলেন অন্য জীবন। সেখানে গান থাকল আর থাকল প্রতিবাদ, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস।
আর ডিলান? নতুন করে সম্পর্ক, বিয়ে ঠিক সেই ঘটনার পরের বছরেই। সংসার হল। কিন্তু সেই খ্যাতি যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এল তাঁর কাছে। অনুরাগীদের ভয়ে পিস্তল নিয়েও ঘুমাতে হয়েছিল তাঁকে একটা সময়। অবশেষে সঙ্গীতের দুনিয়া থেকে খানিকটা স্বেচ্ছাবসর। তবে সেই বৈবাহিক জীবনও টেকেনি তাঁর। সমান্তরালভাবে একাধিক অবৈধ সম্পর্কে থাকার কারণে ডিভোর্স চেয়েছিলেন অর্ধাঙ্গিনী সারা লাউন্ডস।
পরে নিভৃতবাস কাটিয়ে ফেরা ডিলানের সঙ্গে গান গেয়েছেন বায়েজ। একজন বন্ধু হিসাবেই। তার বেশি কিছু না। তবে তাঁদের দু’জনের হাত ধরে আর জন্ম নিল না কোনো নতুন গান। “ইফ ইউ মিস দিস ট্রেন আম অন, দেন ইউ উইল নো দ্যাট আই হ্যাভ গন...” কথাগুলোই চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। কোথাও গিয়ে তা নাড়াও দিয়েছিল কি বব ডিলানকে? ২০০৯ সালে সেই আক্ষেপ থেকেই হয়তো জোয়ান বায়েজের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ডিলান। প্রকাশ্যে। জনসমক্ষে। বিচ্ছেদের ৪৪ বছর পর। বড্ড দেরি করে ফেলেছিলেন কি ডিলান? কে জানে...
তথ্যসূত্রঃ
১। Joan Baez gets her apology, Peter Howell, The Star
২। Bob Dylan: The secret life and loves of a musical icon, Independent
৩। Bob Dylan & Joan Baez - 2009, Documentary Film
Powered by Froala Editor