হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে চার চাকা। ভেতরে রয়েছেন এক খিটখিটে বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোক, তাঁর দেখভালের লোক। গাড়ির সামনে বসে আছেন ভদ্রলোকের বাঙালি মেয়ে; সুন্দরী, তরুণী। যেতে হবে কলকাতায়। কিন্তু বাঙালি পরিবারের ‘কাণ্ডকারখানা’ দেখে ড্রাইভার রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে। এদিকে মেয়েটিকেও ভালো লেগে গেছে তাঁর। কিন্তু ওঁর বাবা? উফ! এভাবেই গাড়ির ভেতরেই শুরু হল ছোট্ট একটা সংসার। গাড়ি হয়ত থেমে যাবে কলকাতায়, কিন্তু যাত্রা কি থামবে? থামতে দেবেন ড্রাইভার ‘রানা’, ইরফান খান?
‘পিকু’ সিনেমায় ইরফানের কমিক টাইমিং ও অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বাংলার সঙ্গে তাঁর যাত্রা, বাঙালির প্রেমে পড়া কিন্তু এখানেই প্রথম নয়। রাজস্থানের ইরফান আলি খানের জীবনে ভীষণভাবে ঢুকে পড়েছিল বাংলা। কি সিনেমায়, কি ব্যক্তিগত চালচিত্রে। মিঠুন চক্রবর্তী বলতে অজ্ঞান ছিলেন ইরফান। তাঁর মতো করে চুল কাটা, ওইরকম নাচের স্টেপ; অনুকরণ চলতই। একপ্রকার অন্ধ ভক্তই ছিলেন মিঠুনের। শুধু চুল আর নাচই নয়, তাঁর অভিনয়েরও। পরবর্তীকালে নানা সাক্ষাৎকারে তাঁর মুখে উঠে এসেছে ‘মৃগয়া’র কথা। এই মানুষটি বাংলার প্রেমে পড়বেন না, তা কখনও হয় নাকি!
ধীরে ধীরে অভিনয় জগতে আসা। টিভি সিরিয়ালের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। ঝড় এসেছে, মেরুদণ্ড শক্ত করে সবকিছুর মোকাবিলা করেছেন। এইসময়ই একটি সিরিয়ালে অভিনয়ের অফার এল। দিল্লি দূরদর্শনের ‘শ্রীকান্ত’, মূল রচয়িতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রীতিমতো ধুতি, পাঞ্জাবী পরে অভিনয় করেছিলেন ইরফান। নিখাদ বাঙালিআনা ফুটে উঠেছিল সেখানে।
কাট টু ১৯৯০। বাংলার অন্যতম প্রথিতযশা পরিচালক তপন সিনহা একটি হিন্দি ছবি পরিচালনার ভার নিলেন। নাম ‘এক ডক্টর কি মওত’। রমাপদ চৌধুরীর ‘অভিমন্যু’ গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ছবিটির চিত্রনাট্য। ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন সৌমেন্দু রায়। বলা যেতে পারে, পুরো বাঙালি টিম। সেখানেই তপন সিনহা ‘অমূল্য’ চরিত্রটির জন্য নির্বাচন করলেন ইরফান খানকে। পরে জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার-সহ নানা পুরস্কার জেতে ছবিটি। সেইসঙ্গে সবার নজরে উঠে আসেন ইরফান। বাংলার হাত ধরেই যাত্রা শুরু হল…
১৯৯৫ সালে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হল। বলা ভালো, ইরফান গাঁটছড়া বাঁধলেন বাংলার সঙ্গে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় পড়াকালীনই আলাপ হয়েছিল সুতপা শিকদারের সঙ্গে। সহপাঠী ছিলেন দুজনে। তাঁর সঙ্গেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ইরফান। সুতপা এখন ভারতীয় সিনেমা জগতের অন্যতম একজন চিত্রনাট্য-নির্মাতা ও সংলাপ-লেখিকা। বাংলার সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা আরও গভীরভাবে জড়িয়ে বসল তাঁকে। পরবর্তীতে রীতিমতো চোস্ত বাংলায় কথা বলতেন তিনি। অনেক সাক্ষাৎকারেও বাংলায় কথা বলে উঠেছেন। আপন করে নিয়েছিলেন একদম। আর সিনেমা তো আছেই। ধীরে ধীরে ভারতীয় সিনেমার জগতে ইরফান খান একটি নাম হয়ে ওঠেন। এমন অভিনয় দক্ষতা, এমন চোখ, এমন হাসি— একে কি এড়ানো যায় এত সহজে!
এরপর ‘দ্য নেমশেক’, ‘শ্যাডোস অফ টাইম’-এও বাঙালি চরিত্রে অভিনয় করেন ইরফান। ‘শ্যাডোস অফ টাইম’ তো নিখাদ বাংলারই ছবি; কলকাতায় শুটিং হয়েছিল, অভিনয়ের ভাষাটিও ছিল বাংলা। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শোভা সেন, তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান। তারপর তো অবশ্যই আসে ‘পিকু’। সুজিত সরকারের ছবিতে অবশ্য বাঙালি নন তিনি; কিন্তু অদ্ভুত মিষ্টি একটা সম্পর্ক তিনি তৈরি করে দিয়ে যান। সেটা কি নিজের কথাও নয়? তাঁর ঘরেই তো রয়েছে বাংলার সংস্কৃতি, তিনি নিজেও তো সেসব থেকে বিচ্ছিন্ন নন…
ইরফান খান ও বাংলা— এই গল্পের শেষটুকু বলতে গেলে কাঁটাতার পেরোতে হবে। হ্যাঁ, ‘ডুব’-এর কথাই হচ্ছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির কোনো বেড়াজাল নেই। বাংলাদেশের পরিচালক মোস্তফা সারওয়ার ফারুকিও তাই মনে করেন। ‘ডুব’ সেজন্য বাংলার সিনেমা, ওপার-এপার সবাই মিলে তৈরি হয়েছে একটা আস্ত গল্পের মহাদেশ। ছবিতে ইরফান একজন চিত্র পরিচালকের ভূমিকায়। পুরো ছবিটাই বাংলা ভাষার ছবি। এই ছবিতে ইরফানের অভিনয় তো আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেয়েছিলই, তার থেকেও বড়ো ব্যাপার হল সিনেমার ভাষা। ওপার বাংলার উচ্চারণে এক অদ্ভুত নেশা ধরানো টান থাকে। ফারুকি চাইছিলেন সেটা যেন লেগে থাকে এখানে। সেই সূত্রে ইরফান খানও সেই উচ্চারণের চর্চা করতে থাকেন। পরে সেই কাজটি এত ভালো ভাবে করেছিলেন যে, স্বয়ং পরিচালকও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এত নিখুঁত বাংলা উচ্চারণ! এখানেই ইরফানের মেধা, পরিশ্রম; এখানেই ইরফানের বাংলার প্রতি ভালোবাসা…
যাত্রা তো একদিন থেমে যায়ই। কিংবা, রাস্তা বদল হয় শুধু। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে সেই বাঁক বদল করলেন ইরফান খান। বাংলার জামাই তো বটেই, বাংলার এক অভিনেতাও। সত্যিকারের এক শিল্পী। সুতপা শিকদার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাড়ির সবাই গল্প করলেও একেক সময় ইরফান নিজের ঘরে ঢুকে যেতেন। মাটিতে বসে বই পড়তেন, সিনেমার চরিত্র নিয়ে ভাবতেন। এতটাই ছিল নিষ্ঠা। এখন হয়ত অন্যভাবে নিজেকে খুঁজবেন তিনি। ইরফান খানই তো বলেছিলেন, “মহব্বত হ্যায় ইসিলিয়ে তো জানে দিয়া; জিদ হোতি তো বাহোঁ মে হোতি”…