‘এমনকি নিজের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে বেশ্যার কাজও করতে পারি। প্রয়োজন পড়লে চুরি করব, শিল্পের কারণে নিজের বন্ধুকেও খুন করতে রাজি আছি।’
কিন্তু না। পাঁচ বছর পরেও এই কথার জন্যে তেমন অনুতাপ তাঁর ছিল না, যখন প্লেবয় ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন ইঙ্গমার বার্গম্যান, সুইডেনের কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার। ...‘এমনটা হতে পারে, তখন আমি অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক ছিলাম। আত্মরক্ষার একটা দিক তো আপনারা জানেনই, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা। এখন অবশ্য আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, বয়সও হয়েছে।’ তখন ১৯৬৩ সাল, স্টকহোম শহরে বসে তিনি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরের ছবির জন্য।
কিছু দিন আগেই ‘দ্য সাইলেন্স’ মুক্তি পেয়েছে, সমালোচনার ঝড় ঝাপটা সদ্য সামলে উঠেছেন তিনি। প্লেবয়কে সাক্ষাৎকারে এই নিয়ে নিজের অসহায়তাও প্রকাশ করেন শিল্পী, ‘অথচ ঐ দৃশ্যগুলি বাদ দিয়ে ছবিটিই হত না!’ বার্গম্যানকে বিঁধেছিল লুথেরান চার্চ ও রক্ষণশীল গণমাধ্যম। জনতাকে স্থূলভাবে আঘাত করার জন্যেই ঐ যৌনদৃশ্যগুলি তিনি রেখেছেন, এমনটাই ছিল অভিযোগ।
এমন কী দেখিয়েছিলেন বার্গম্যান, যাতে এতখানি প্রতিক্রিয়া? ছবির নায়িকা রোগগ্রস্ত এস্থার (ইংগ্রিড থুলিন অভিনীত চরিত্র) একাকী শয্যায় নিজের পাজামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে স্বমেহন করছে, এই দৃশ্যটি বিতর্কের মুখে পড়ে। এছাড়াও দু’টি আলাদা সঙ্গমদৃশ্য বার্গম্যান তুলেছিলেন, যার একটির সাক্ষী ছিল এস্থারের বোন আনা, অন্যটিতে সে-ই অংশ নিয়েছিল। যৌন আবেদনের চেয়েও দৃশ্যগুলির শক এলিমেন্ট-ই বেশি ঝাঁকুনি দেয় ষাটের দশকের দর্শককে।
সত্তর দশকে ‘কলকাতা’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় সমর্থন করেন বার্গম্যানের সিদ্ধান্তকে। ‘অনেক ছবিতেই দেখি পরিচালক যৌনতাকে বাজার-চাহিদার কথা ভেবে ব্যবহার করছেন... কিন্তু ‘দা সাইলেন্স’-এ যেভাবে দেখানো হয়েছে, ওভাবে ছাড়া ছবিটা হতই না।’ ‘ছবিতে যৌনদৃশ্য’ প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেন রোমান পোলানস্কি পরিচালিত ‘রিপালশন’ (১৯৬৫) ছবির কথা ।
নিজের কেরিয়ারের শীর্ষ সময়ে বার্গম্যান যে ছবিগুলি করেন, ‘সাইলেন্স’ এবং আগের ছবি দু’টি এদের মধ্যে পড়বে। ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’ (১৯৬১), ‘উইন্টার লাইট’ (১৯৬৩) ও ‘দা সাইলেন্স’ (১৯৬৩) - এই তিনটি ছবিকে একসাথে বলা হয় ‘চেম্বার ট্রিলজি’। ভবিষ্যতে ‘বার্গম্যানোচিত’ ছবি বলতে এই ‘চেম্বার’ ধরনটিকে দর্শকরা চিনতে শিখবেন, যেখানে স্বল্প ও বদ্ধ পরিসরে ‘চেম্বার সঙ্গীত’-এর আদলে হাতে-গোনা চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিছবি গড়ে ওঠে।
‘হ্যাঁ, আমি একটা পুরোনো নীতিবাক্য এই ছবিগুলোয় বলতে চেয়েছিলাম। সেটা হচ্ছে এই, ‘ঈশ্বর হলেন প্রেম এবং প্রেমই হল ঈশ্বর।’ ...পরে যদিও আমি এই মত থেকে সরে আসি,’ জানিয়েছেন বার্গম্যান।
তিনটি ছবিতেই ছিল তিনটি আলাদা গল্প, মিল ছিল শুধু থিম ও আঙ্গিকে। স্কিজোফ্রেনিক যুবতী কারিন (‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’), অবিশ্বাসী পাদ্রী টমাস (‘উইন্টার লাইট’), রোগাক্রান্ত এস্থার (‘দা সাইলেন্স’) – এই তিন চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালক ফয়সালা চেয়েছিলেন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক প্রশ্নগুলোর। ‘ঈশ্বর কি আছেন, থাকলে তিনি কেন নীরব?’ অথবা, ‘ঈশ্বরহীন জগতে ন্যায় কী?’ ...‘আমরা কীসের লক্ষ্যে বেঁচে থাকব, যদি আমাদের ধরবার মতো কোনো বিশ্বাস না থাকে!’ কারিন, টমাস, এস্থার কিংবা পার্শ্বচরিত্র হিসেবে প্রৌঢ়া মার্তা, যুবতী আনা, শিশু যোহান, কিশোর মিনুস সকলেই হাতড়ে বেরিয়েছিল উত্তরহীন কুয়াশায়।
বার্গম্যানের ছবি, বিশেষত ‘দা সাইলেন্স’ নিয়ে সবসময়েই আচ্ছন্ন ছিলেন সত্যজিৎ। ‘চারুলতা’ (১৯৬৫) ছবির মেজাজে, নির্মাণে বার্গম্যানের থেকে তাঁর অনেক ঋণ। উত্তর-পর্বের সত্যজিৎ নিসর্গ-নির্ভর ছবি খুব একটা করেন নি। ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৮৪) থেকে ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) পর্বের ছবির বেশিটাই অন্তর্দৃশ্য, যার একটা কারণ অবশ্যই ছিল পরিচালকের বার্ধক্য। এই ছবিগুলির ভাষায় পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সঙ্গীতের ঝোঁকও লক্ষ্য করা যাবে, যা বার্গম্যানের সঙ্গে তাঁর মানসিক নৈকট্যের নজির।
মনে পড়ে কি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ‘পিকু’ (১৯৮০) ছবিটির কথা? এই ছবির কাহিনি-উৎস সত্যজিতেরই একটি গল্প। কিন্তু ছবিটি একটু মন দিয়ে যদি দেখি এবং মনে রাখি সত্যজিতের ‘দা সাইলেন্স’-প্রীতির প্রসঙ্গ, বুঝতে একটুও অসুবিধা হবে না যে, ‘পিকু’ ছবিটি অগ্রজ সুইডিশ শিল্পীর প্রতিই হোমাজ। সত্যজিৎ রায়ের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ‘পিকু’র ভাষা বা মোটিফ সবই নির্দেশ করেছে ১৯৬৩ সালের বিতর্কিত ছবিটিকে।
সাদৃশ্যগুলি লক্ষ্য করুন। ‘দা সাইলেন্স’ ছবিতে হোটেলের করিডোর থেকে করিডোরে হেঁটে বেড়ায় বালক যোহান। ‘পিকু’ ছবিতে বালক পিকুকে আমরা দেখি বাগান থেকে বারান্দার হেঁটে যেতে, ড্রয়িং খাতায় ছবি আঁকতে। ‘সাইলেন্স’-এ হোটেলের বিছানায় শুয়ে থাকে রোগিণী এস্থার। এদিকে পিকুর দাদুকে আমরা দেখি মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে। পিকুর মা ও মায়ের প্রেমিক শোওয়ার ঘরে সঙ্গমরত, যেভাবে যোহানের মা আনা একটি স্থানীয় পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে হোটেলেরই অন্য ঘরে।
বার্গমানের যোহান এক নিষ্পাপ সত্তা, বড়দের দুর্দশা ও কদর্যতার একলা পর্যবেক্ষক। একই ভাবে সত্যজিতের পিকু আবিষ্কার করে দাদুর মৃতদেহ, অথচ তখন তার কিছুই করার নেই, বাবা তখন কাজের জায়গায়, বন্ধ শোয়ার ঘরে মা ও হিতেশকাকু। পিকু কী করবে নিজে বুঝতে পারে না, একলা ছবি আঁকতে শুরু করে বারান্দায় বসে। রেল-কামরায় বসে যেমন বালক যোহান বোঝে না মৃত্যুপথযাত্রী এস্থারের চিঠির অর্থ, কিন্তু বোঝার নিস্ফল চেষ্টা করতে থাকে। যেমন একই ভাবে বাঙালি অতিওর নীরবে বুড়ো আঙুল তুলে রাখেন সুইডিশ অতিওরের জিজ্ঞাসার সমর্থনে।