কখনও বিকাশ রায়কে বলছেন, 'গৌরহরি নে বাতায়া মুর্দা হাতি কা দাম লাখ রুপাইয়া জিন্দা হাতি কা দাম কুছ ভি নেহি'। কখনও আবার 'ছো ছো ছো ক্যায়া শরম কী বাত' গাইছেন, আবার হাড়ভাঙা গ্রামের প্রেসিডেন্ট হয়ে বলছেন, 'কী বলেছিলাম না! শিল্ড আমি গ্রামের বাইরে যেতে দেব না!’ আবার কখনও, সাড়ে চুয়াত্তরে গান জুড়ে দিলেন 'একবার নেমে আয় নেমে আয় ও বাপ কেদার আমার’। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, জহর রায়ের কথাই বলছি। প্রায় তিনশো সিনেমায় অভিনয়, যার মধ্যে একটি আবার হিন্দি। নাটক যে কত, তার ইয়ত্তা নেই।
এ বছর সত্যজিৎ-এর জন্ম শতবর্ষ চলছে, আর দু-বছর আগেই ২০১৯-এ আমরা পেরিয়ে এসেছি জহর রায়ের জন্মশতবর্ষ। এই দুই রথী-মহারথীর একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে, ফলত কয়েকটি ঘটনাও ঘাটেছে। সত্যজিৎ-এর দুটি ছবি পরশপাথর ও গুপী গাইন বাঘা বাইন-এ অভিনয়ও করেছেন জহর রায়।
১৯৫৮ সালে পরশুরামের গল্প নিয়ে সত্যজিৎ বানালেন পরশপাথর, তুলসী চক্রবর্তীর চাকর ভজহরির ভূমিকায় জহর রায়। ছোটো পার্ট। সেই প্রথমবারের জন্যে মানিকের ছবিতে জহর।
ছবির শুটিং চলছে, তার ফাঁকেই বসত রত্নদের আড্ডা। হঠাৎই একদিনের আড্ডায় বয়সের প্রসঙ্গ উঠল। জানা গেল, মানিক বাবুর জন্ম ১৯২১-এ আর জহর রায়ের জন্ম ১৯১৯ সালে।
আরও পড়ুন
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেছেন ভানু, করেছেন গুপ্তচরের কাজও
বয়স জানতে পেরেই সত্যজিৎ বলে উঠলেন, "সে কী জহরবাবু, আপনি তো দেখছি আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো। তা হলে আমাকে মানিকদা বলে ডাকেন কেন?"
আরও পড়ুন
টালিগঞ্জে 'ব্রাত্য' ভানু, সংসার চালাতে করেছেন যাত্রাও!
তক্ষুনি পাল্টা জবাব জহরের, "আমি আপনার চেয়ে এজ-এ বড়ো, কিন্তু আপনি যে আমার চেয়ে ইমেজে বড়ো!"
আরও পড়ুন
চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য জহর রায় দাঁড়িপাল্লায় তুলেছিলেন ব্রহ্মাকেও
এক্কেবারে স্পয়লার যাকে বলে, মুহূর্তের মধ্যেই আড্ডায় নিস্তব্ধতা। খানিক বাদেই সেই বিখ্যাত সত্যজিতীয় ব্যারিটোনে প্রাণখোলা হাসি।
এর এক দশক পরের ঘটনা। ১৯৬৮ সাল। জয়সালমিরে গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর শুটিং করেছেন সত্যজিৎ। ইউনিটের সবাই পৌঁছে গিয়েছেন। কিন্তু হাল্লা রাজের মন্ত্রী এসে পৌঁছাননি। ওই ভূমিকায় ছিলেন জহর রায়। তিনি কলকাতার শুটিং সেরে আসবেন। যোধপুর থেকে দেড়শো মাইল ট্যাক্সিতে আসবেন তিনি, কিন্তু নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছলেন না। রাত দশটা বদলে এলেন রাত্তির আড়াইটার পরে।
কী ব্যাপার জিগ্যেস করতেই, তিনি জানালেন তাঁর গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। জানা গেল, মাঝপথে চলন্ত গাড়ি উল্টে গিয়েছিল। জহর রায়ের নাকে যে লেগেছিল সেটা অনেকেই দেখে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি বর্ণনা দিলেন ভুঁড়ির, যেন ভুঁড়ি চরিতমানস বা ভুঁড়ি মঙ্গলকাব্য বা ওই জাতীয় কিছু একটা।
বলতে শুরু করলেন, আরে মশাই চাঁদনি রাত, ষাট মাইল স্পিডে চলেছি, দিব্যি পিচঢালা রাস্তা, অন্য গাড়ির চলাচল নেই— সর্দারজি ড্রাইভার বাঁ হাত কাঁধের পিছনে রেখে ডান হাতে আপেল নিয়ে তাতে কামড় দিচ্ছেন, স্টিয়ারিং-এ রেখেছেন নিজের ভুঁড়িটি। সেটাকে একটু এদিক ওদিক করলেই গাড়ি এদিক ওদিক ঘুরছে। এমন সময় হুশ করে রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেল খরগোশ। তাকে বাঁচাতে গিয়েই গাড়ি গেল উল্টে। আমার হুঁশ ছিল, দেখলাম গড়াচ্ছি। আর আমার পাশ দিয়ে গড়াচ্ছে দুটো হোলডঅল। খটকা লাগল, হোলডঅল তো সঙ্গে একটি, অন্যটি এল কোত্থেকে? বুঝলাম ওটি হলেন আমাদের সর্দারজি। ব্যাস ভুঁড়ি বৃত্তান্ত এখানেই শেষ।
চার্লি চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য জহর যে তাঁর নিজস্ব ইম্প্রভাইজেশান ক্ষমতাকে প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বর্ণনা কেবল অতিরঞ্জন মাত্র। সত্যজিৎ এ নিয়ে লিখেছিলেন, জহর বাবু, ড্রাইভার সাহেব আর গাড়ি, এই তিনটের কোনোটাই খুব বেশি জখম হয়নি। শুটিং-এও হাল্লার মন্ত্রী অর্থাৎ জহর রায়ের অভিনয় করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
এর মাঝের এক ঘটনা। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক দু-দিন আগের কথা, কুমোরটুলি থেকে একের পর এক ঠাকুর বেরোচ্ছে। কোনো এক কারখানার এক দল কর্মচারী তাঁদের বিশ্বকর্মা মূর্তি নিয়ে যাচ্ছে লরি করে। চলছে হইহুল্লোড় নাচানাচি, সেই নাচ দেখতে গিয়েই জহর রায়ের চোখে পড়ল একটা মজার দৃশ্য। সে যুগের হলেও, আসলে তো কনটেন্ট ক্রিয়েটার। জহুরি থুড়ি, জহর জহররূপী রসদ চিনে নিলেন।
লরির উপর যারা নাচছিল, তাদের হাতে বিশ্বকর্মার বাহন হাতির শুঁড়! বুঝতে দেরি হল না, যে বিশ্বকর্মার বাহনের শুঁড়টি ভেঙে গিয়েছে। সেটাই মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে চলছে লরি সঙ্গে সকলের উদ্দম নৃত্য। সঙ্গে সঙ্গে ছকে ফেললেন দৃশ্যটা। ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় গ্র্যান্ড হোটেলের নিচে ‘নিউ ক্যাথে’ রেস্তরাঁয় বসে সবে ঠোঁটে গেলাস ছুঁইয়েছেন, অমনি মাথায় খেলে গেলো জবরদস্ত প্লট। সামনেই ছিল দুর্গাপূজা, দুর্গাপ্রতিমাকে কেন্দ্র করেই এরকম একটা কৌতুকাভিনয় করলে কেমন হয়! যেই ভাবা সেই কাজ।
বাড়ি ফিরে জহর রায় লিখে ফেললেন ‘ন্যাপাসুর বধ’। তবে এই গল্পে শুঁড় নিয়ে কিছুই হয়নি, হয়েছিল আসুর নিয়ে। দুর্গাপ্রতিমা আনতে গিয়ে ভেঙে গেল আস্ত অসুরটাই, সময় নেই আর এখন অসুর পাওয়া যাবে কোথায়! কিন্তু পাড়ার ন্যাপা থাকতে চিন্তা কী! মুশকিল আসান ন্যাপাই তো আছে। মাটির মহিষাসুরের বদলে প্রক্সি দিতে পাওয়া গেল পাড়ার কাঠবেকার নেপাল চন্দ্র ওরফে ন্যাপাকে। তারই নানান কাণ্ডকারখানা নিয়ে সপ্তমী থেকে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত হাস্যকৌতুক শ্রুতিনাটক গোছের একটা উপস্থাপনা।
পুজোর আগেই এর রেকর্ডিং হল। রেকর্ড বিক্রি হল সেই রেকর্ডিং, জটায়ুর ভাষায় সেলিং লাইক হট কচুরিজ। গগনচুম্বি জনপ্ৰিয়তা! প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সেই বছর শুধুই জহর রায়ের ‘ন্যাপাসুর বধ’ বাজছে।
অন্য কৌতুকশিল্পীরাও ছোটখাটো অনুষ্ঠানে এই উপস্থাপনা করে শোনাতে লাগলেন।
তদানিন্তন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘উল্টোরথ’-এর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চেও ‘ন্যাপাসুর বধ’ শুনিয়েছিলেন জহর রায়। দর্শকাসনে ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ।
জহরবাবুর অভিনয় দেখে সেই ব্যারিটোনে আকাশ বাতাস কাঁপানো হাসি হেসেছিলেন সত্যজিৎ। সেখানে উপস্থতি জনৈক আলোকচিত্রী এ-সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হাতছাড়া করেননি। ঝোপ বুঝে দিলেন কোপ! মানিকের হাসিমুখের ছবিটিতে তিনি ধরে রাখলেন যন্ত্রে, হাসি মুখে সত্যজিতের আলজিভ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
এই ছবি প্রসঙ্গে পরবর্তীতে জহর রায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘গ্রেটম্যানরাই এ রকম প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে।’’
এর অনেক দিন পরের ঘটনা। রঙমহলে (যেখানে জহর রায় নাটক করতেন) বসে উল্টোরথের সাংবাদিক রবি বসুকে এক দিন জহর রায় প্রশ্ন করলেন, "হ্যাঁ রে রবি, তুই কখনো সত্যজিৎ রায়ের আলজিভ দেখেছিস?"
রবি বসু শুনেই অবাক! স্বভাবিক। আকাশ থেকে পড়েই তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, 'সত্যজিতের আলজিভ কি চাইলেই দেখা যায় নাকি?'
জহর বললেন, ‘দেখার যদি ইচ্ছে থাকে, কাল সকালে আমার মেসে চলে আয়।’
কলেজ স্কোয়ারের কাছে ৭১/১ পটুয়াটোলা লেনে ‘অমিয় নিবাস’-এর তিনতলায় দুটি ঘর ছিল তাঁর ডেরা, এখানেই তিনি পড়তেন, বই রাখার জন্যেই এ ঘর নেওয়া। তথাকথিত মাচায় অনুষ্ঠান করে যা আয় হত, তা দিয়ে বই কিনতেন। এই বইই ছিল তাঁর বিলাসিতা। বই কেনার জন্যে খাতাও ছিল তাঁর।
সুবর্ণরেখা প্রকশনীর ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মতে, ‘১৯৫০ থেকে ৭০— এই কুড়ি বছরে কলকাতায় যত ভালো বই এসেছে তার প্রায় সবই ছিল জহরবাবুর সংগ্রহে।’ তাঁর মৃত্যুর পরে অবশ্য সে সব বিতরণ করা হয়েছিল। যাক সে অন্য কথা।
রবি বসু শুনেই, পরদিন সকালে হাজির হয়েছিলেন সেই ডেরায়।
চা-টোস্ট খেয়ে, এটা-সেটা গল্প শুনছেন, তার মন সেই আলজিভে পড়ে আছে। কিন্তু কিছুতেই ঐ কথায় আসছেন না জহর বাবু। তর সইতে না পেরে শেষটায় রবি বসু বলেই বসলেন, ‘তুমি যে কাল ডেকেছিলে একটা জিনিস দেখাবে বলে?’
জহর রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলের ড্রয়ার টেনে বের করলেন সত্যজিৎ-এর মস্ত বড় একখান ছবি। যাকে বলে বিগ ক্লোজ আপ।
হাসছেন মানিক বাবু, যাকে বলে অট্টহাসি এক্কেবারে আল্লাদে আটখানা হয়ে। আলজিভটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁর!
রবি বসু এ ছবি দেখা মাত্রই হতাশায় ভেঙে পড়লেন। সত্যজিৎ-এর এই ছবি তো উল্টোরথেরই সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের, যেখানে ‘ন্যাপাসুর বধ’ শুনিয়েছিলেন জহর রায়।
তথ্য ঋণ :
১) একেই বলেই শুটিং - সত্যজিৎ রায়।
২) রবি বসু : স্মৃতির সরণিতে, বর্তমান পত্রিকা।
Powered by Froala Editor