শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে নিজের চোখে দেখেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!

কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী স্বর্ণকণ্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষপূর্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আমরা। সেইসঙ্গে আমরা সদ্য পেরিয়ে এলাম শিল্পীর একত্রিশতম প্রয়াণবার্ষিকী। বাংলা ও হিন্দি আধুনিক এবং ছায়াছবির গানে তো বটেই, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তিনি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। কবিগুরুই যে তাঁর সুরসৃষ্টির অন্যতম প্রধান প্রেরণা – এ’কথা তিনি স্বয়ং স্বীকার করেছেন বারবার। মানসগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাণকেন্দ্র শান্তিনিকেতন এবং আশ্রমের বিশিষ্ট কিছু মানুষের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যোগসূত্র ঠিক কেমন ছিল – এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করা আজকের দিনে বোধয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম শান্তিনিকেতনে যান কিশোর বয়সে। শান্তিনিকেতনে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিজের চোখে দেখেছিলেন, যদিও এই বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ তেমন পাওয়া যায় না। ১৯৪৩ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকলেও শৈলেশ দত্তগুপ্তের কল্যাণে ‘রবীন্দ্রগান প্রকৃতপক্ষে কী’ সেটা অনুধাবন করতে লেগেছিল আরও কয়েকবছর। ১৯৪৫ সাল অর্থাৎ বিয়ের আগেই দুই বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায় এবং সমরেশ রায়কে সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন শান্তিনিকেতনে। তখনই আলাপ হয়েছিল আশ্রমকন্যা কণিকা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুত্রেই তাঁর বন্ধু বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে কণিকা মুখোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে শান্তিনিকেতনে যে বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠান হয়, সেই অনুষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের ভার ন্যস্ত ছিল শান্তিদেব ঘোষের ওপর। সেই সময় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফে শান্তিদেব ঘোষ গান করবার জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানান। বহু কর্মব্যস্ততার মধ্যেও হেমন্তবাবু সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন এবং সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে হেমন্তর নিবিড় যোগের আরেকটা কারণ হল বিশ্বভারতীর স্বনামধন্য প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক সুধাকর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘তুতো’ দাদা। ’৬১-তে বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণে হেমন্তবাবু রতনকুঠিতে অতিথি নিবাসে উঠলেও তিনি সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন একাধিকবার এবং আশ্রমের কেউ দেখা-সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি সেখানেই কথা বলতেন। আশ্রমের পরিবেশও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পছন্দের ছিল।

সেইসময় শান্তিনিকেতনের আশ্রমের মানুষজনের প্রায় প্রত্যেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নামটির সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ‘শ্যামা’-তে ‘বজ্রসেন’-এর ভূমিকায় হেমন্ত বাবুর গান সে’বছরই। যারা বেতার বা রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন তারা এবং আশ্রমের গুটিকয়েক মানুষ যারা আধুনিক গানও কিছু শুনতেন তাদের মধ্যেও হেমন্তবাবুর অনুরাগী সংখ্যা খুব কম ছিল না। তাই এমনও হয়েছে যে শান্তিনিকেতনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে হয়ত একদিন বললেন, ‘একটু বিশ্রাম নিতে এলাম। কাউকে বলবেন না আমি এখানে আছি।’

শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গ এলে বিশ্বভারতীর প্রসঙ্গ তো এসে পড়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুমোদন না করার ব্যাপারটা একটু অপ্রিয় প্রসঙ্গ বলে অনেকেই এড়িয়ে যান। জর্জ বিশ্বাসের মতন অতখানি না হলেও বিশ্বভারতীর স্টিমরোলারের হাত থেকে রেহাই পাননি হেমন্তবাবুও। তবে এ প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর নিয়মকানুনের বেড়াজাল আর তার ফাঁক-ফোকর – বেশ অবাক করে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ‘গগনে গগনে আপনার মনে’ গানটিতে তিনি প্রতিটি স্তবকের শেষে যে আবর্তন করেছেন, যে লয়ে গেয়েছেন, তা এক সময় বিশ্বভারতীর অনুমোদন পায়নি। অথচ ‘চরণ ধরিতে’ গানটির ক্ষেত্রে এ জাতীয় শৈল্পিক স্বাধীনতা আরও স্পষ্ট, কিন্তু এ গানটির অনুমোদন পেতে কোন অসুবিধে হয়নি। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।    

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণের পরের দিন সকালে শান্তিনিকেতনে সকালের সাপ্তাহিক উপাসনায় তাঁর উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শান্তিনিকেতনে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে নীরবতা পালিত হয়। সেইদিনই অর্থাৎ ২৭শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সঙ্গীতভবনে একটি নাটক অভিনীত হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল করা হয়।

যাই হোক, এখানে শেষের কথা বেশি বলতে চাই না। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এক গোপন আত্মিক যোগ ছিল এবং সেই সংযোগ গ্রন্থিটি ছিল রবি-সূত্রে বাঁধা। শান্তিনিকেতনের মানুষেরা যতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চা করবেন, ততদিন তাঁদের একবার না একবার আশ্রয় নিতে হবেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পৌরুষ এবং মেধা-দীপ্ত আত্মমগ্ন রবীন্দ্রগান পরিবেশনার গর্ভগৃহে। 

আরও পড়ুন
‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি’, ভারত-চিন যুদ্ধে গানই হাতিয়ার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

তথ্যসূত্রঃ

১) ‘আনন্দধারা’ – কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (‘আজকাল’)

২) ‘আমার গানের স্বরলিপি’ – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়/সম্পাদনা ও গ্রন্থনা – শঙ্করলাল ভট্টাচার্য (‘এ মুখার্জি এ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড’)

আরও পড়ুন
শহরজুড়ে দাঙ্গা; কলিম শরাফীকে লুকিয়ে রাখলেন দেবব্রত বিশ্বাস, জানতে দেননি হেমন্তকেও

৩) ‘সুরের আকাশে হেমন্ত’/সংকলক – জয়দীপ চক্রবর্তী (‘সূত্রধর’)

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – শ্রীমতি আলপনা রায় (মুনিয়াদি) ও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘দাস্তাঁ আগে অওর ভি হ্যায়’: গীত, গজল এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

More From Author See More