উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চল। গলি পেরিয়ে খানিক এগোলেই দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন ঠাকুরের বিরাট সাম্রাজ্য। ঠাকুরবাড়ির ভেতর একটু একটু করে বেড়ে উঠছে কত নতুন কুড়ি। নিজের ঘরে বসে আছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋষিপ্রতিম চেহারা, তেমনই ব্যক্তিত্ব। ঘরে একটি কিশোরী নতুন সুর ভাঁজছে। দেবেন ঠাকুর মন দিয়ে শুনছেন, আর দেখছেন কিশোরীটিকে। আহা, বড়ো সুন্দর সুর বেঁধেছে মেয়েটা! বঙ্কিমবাবুর লেখা ‘বন্দে মাতরম’-এর আত্মার সঙ্গে এক হয়ে গেছে এই সৃষ্টি। মেয়েটি এগিয়ে এল তাঁর কাছে। প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ। সম্পর্কে নাতনি হয় সে; মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা— সরলা। যেমন রূপ, তেমন গুণ, শিক্ষা। সেইসঙ্গে আরও একটি গুণ রয়েছে— তেজ আর অসীম সাহস।
সবই তো হল, কিন্তু বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে। তখনও সমাজে বিবাহযোগ্যা মেয়েদের বয়সসীমা ছিল অনেক কম। সরলার এখন বিয়ে না দিলে যদি পাত্র পেতে অসুবিধা হয়? সরলাকে কাছে ডেকে পছন্দের পাত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। “না, আমি বিয়ে-থা করব না!” সটান দাদুর মুখের ওপর বলে বসল সরলা। মেয়ের তেজ দেখে অবাক দেবেন্দ্রনাথ। সরলার উজ্জ্বল চোখদুটি দেখে মনে মনে মুগ্ধই হলেন মহর্ষি। নিজেই ঠিক করলেন, কোনো মানুষ নয়; সরলার বিয়ে দেবেন একটা তরোয়ালের সঙ্গে!
একটা সময় বিয়ে হয়েছিল ঠিকই। সরলা ঘোষাল বদলে গিয়েছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানীতে। কিন্তু মানুষ সরলা সেই তরোয়ালের মতোই; ঝকঝকে, তীক্ষ্ণ, উদ্দিপ্ত এক নারী। ঠাকুর পরিবারের অন্যতম নক্ষত্র সে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ প্রাপক। কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন এমনকি রবীন্দ্রনাথের গানের সুরও দিয়েছেন। ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’, ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’- এমন অনেক গান যা আজও আমরা গুনগুন করে উঠি অজান্তে, তার সুরের পটভূমিকায় রয়েছেন সরলা দেবী।
আর সাহস? সেরকম অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে জীবনে। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক এবং ‘জাঙ্গল বুক’-এর স্রষ্টা রুডইয়ার্ড কিপলিং কোনো একটি গল্পে বাঙালি জাতিকে ‘গিদ্দড়’ বলেছিলেন। এমন খবর শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারেননি সরলা। সোজা চিঠি লিখলেন কিপলিংকে। আহ্বান করলেন যুদ্ধের মঞ্চে; তাঁর ‘ভাইয়েরা’ যে হারিয়ে দেবে ইংরেজদের সে ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু পাঠাবেন কী করে? ঠিকানা যে জানা নেই! এমন সময় ঠিক করলেন বাঙালি যুবকদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে হবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। সার্কুলার রোডের বাড়িতে তৈরি হল আস্ত একটি ক্লাব। সেখানে প্রশিক্ষক নিয়োগ করে বাঙালি যুবকদের অস্ত্রশিক্ষা শুরু করলেন তিনি। মহারাষ্ট্রের ‘শিবাজি উৎসব’-এর বদলে বাংলায় শুরু করলেন ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’। একা একজন নারী নিজের উদ্যোগে এমন একটা জিনিস শুরু করেছে, এই উদাহরণ তখনকার দিনে বিরল! সরলা অচিরেই হয়ে উঠলেন বাংলার ‘জোয়ান অফ আর্ক’…
আরও পড়ুন
শান্তি দেবী কি সত্যিই জাতিস্মর? গবেষণায় আগ্রহী খোদ গান্ধীজিও
এমনই তেজ আকৃষ্ট করল আরও একজনকে। তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। পারিবারিকভাবে কংগ্রেসি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সরলা। বাবা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতা। কলকাতাতেই প্রথমবার গান্ধীজি আর সরলার সাক্ষাত হয়েছিল। তখন অবশ্য গান্ধীজি ভারতীয় রাজনীতিতে নবাগত, ‘মহাত্মা’ হননি। ১৯০৫ সালে লাহোরের এক পাঞ্জাবি আইনজীবী ও সাংবাদিক রামভুজ দত্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সরলা। তারপরও দুজনে মিলে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন। সেই তেজ, সেই উজ্জ্বল দেবীপ্রতিম চেহারা। এলাহাবাদে এসে ভারতের প্রথম মহিলা দ্বারা পরিচালিত সংস্থা ‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’ও তৈরি করলেন তিনি। এইসময়ই এল বদল। এককালে যে সরলা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, অস্ত্রশিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনিই মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি আস্থা দেখালেন।
আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি
এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলাপ ছিল সুগভীর। লাহোরে রামভুজ দত্তের বাড়িতে প্রায়শই যেতেন গান্ধীজি। সেখানে সরলা দেবী চৌধুরানীর সঙ্গে আরও ভালো করে আলাপ করলেন। তখন তিনি কস্তুরবা গান্ধীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তা সত্ত্বেও সরলার সাহসী চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন তিনি। তাঁদের বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল। সেখানে শুধুই ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মর্যাদা আর সম্মানের বৃত্ত। সেই সময় বহু চিঠি আদানপ্রদান করেছিলেন দুজনে। সেই সমস্ত কিছু সেই সময়ের প্রামাণ্য নথি হয়ে থেকে গেছে। তরোয়ালের বিদ্রোহ থেকে জীবন এগিয়ে গিয়েছিল চরকায়। তার ওপর সঙ্গীতের ওপর বাল্যকাল থেকেই ছিল অসামান্য প্রজ্ঞা। গান্ধীজি মন দিয়ে বসলেন সরলাকে।
আরও পড়ুন
ব্র্যাডম্যানের খেলা দেখতে চেয়ে কারাগারে মহাত্মা গান্ধীর ছেলে!
নিজের আত্মকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’তে গান্ধীজির কথা উল্লেখ করেছেন সরলা দেবী চৌধুরানী। অন্য সূত্র থেকে জানা যায়, গান্ধীজি সরলাকে ‘স্পিরিচুয়াল ওয়াইফ’ বা আধ্যাত্মিক স্ত্রী রূপেও গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন! সমস্ত শরীর মনের ঊর্ধ্বে উঠে এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ই গান্ধী পরিবারে শুরু হয় ব্যাপক সমস্যা। বিবাহিতা স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী রীতিমতো অসন্তুষ্ট হন। শেষ পর্যন্ত তাঁর চাপেই সরে আসেন মহাত্মা গান্ধী। থেমে যায় একটা ‘আধ্যাত্মিক সম্পর্ক’। ভারতের ইতিহাসের দুই ব্যক্তিত্ব এভাবেই কোথাও এক হয়ে গিয়েছিলেন। পরে নিজের একমাত্র ছেলের সঙ্গে গান্ধীজির ভাইপোর মেয়ের বিয়ে দেন সরলা দেবী চৌধুরানী। রামভুজ দত্ত মারা গিয়েছিলেন আগেই। এবার তিনি মন দেন আধ্যাত্মিকতা চর্চায়। সেই সাহসী, তেজস্বিনী সরলা এবার একটু শান্তি চান…
তথ্যসূত্র-
১) ‘Mohandas: A True Story of a Man, His People and an Empire’, Rajmohan Gandhi
২) ‘Gandhi: The Years That Changed the World, 1914 to 1948’, Ramachandra Guha
৩) The Telegraph, 11 March 2007, ‘A VERY DIFFERENT LIFE - Sarala Debi need not only be remembered as Gandhi's great love’
৪) বসুন্ধরা ব্লগ, ১ এপ্রিল ২০১৭, ‘বাংলার দেবী চৌধুরানী ও গান্ধীজির প্রেম’
৫) দৈনিক আজাদি, ২৯ আগস্ট ২০১৯, ‘গান্ধী ও সরলা : যা জানি, যা জানি না’
Powered by Froala Editor