১৭০ বছর পর ফিরল ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন

ছোট্ট একটি আংটির মধ্যে দিয়েই গলে যেতে পারে সম্পূর্ণ একটি শাড়ি। এমনই অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর শিল্প ঢাকার মসলিন। কিন্তু গত ১৭০ বছরে সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত হয়েছে সেই শিল্পই। তবে ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবিত করতেই বছর কয়েক আগে উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। সফল হল সেই উদ্যোগ। দীর্ঘ দেড় শতকেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশে বোনা হল ঐতিহ্যবাহী মিহি-মসলিনের শাড়ি।

শেষ ১৮৫০ সালে ঢাকাই মসলিনের প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে। তবে সেই শাড়ির গুণমান এবং অবাক করা চরিত্র ব্রিটিশদের তৈরি কাপড়ের বৈশ্বিক ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে ভেবেই তা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকরা। প্রচলিত আছে কেটে নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের মসলিন শিল্পীদের আঙুল। তারপর থেকেই চিরতরে হারিয়ে যায় ঢাকাই মসলিন। ভারতে এখনও এই কাপড় বোনার চল থাকলেও বাংলাদেশে আর কোনোদিন বোনা হয়নি এই শাড়ি।

২০১৪ সালে শতাব্দীপ্রাচীন এই ঐতিহ্যকেই ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশেই গঠিত হয় সাত সদস্যের একটি বিশেষ গবেষক দল। নেতৃত্বে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেন। এই শিল্পকে নতুন করে পুনর্জন্ম দেওয়ার জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জই ছিল খুঁজে বার করা উপযুক্ত কার্পাস প্রজাতিকে। কারণ, যে কোনো তুলা থেকে এই মিহি মসলিন তৈরি করা যায় না।

কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই মসলিনের সামান্যতম নমুনাও সংরক্ষিত নেই বাংলাদেশে। তা সবটাই সেসময় অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। কাজেই নমুনার সঙ্গে বাংলাদেশে উৎপাদিত তুলো প্রজাতিগুলির ডিএনএ-সিক্যুয়েন্স মিলিয়ে দেখা বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গবেষকদের কাছে। তথ্য বলতে শুধুমাত্র হাতে ছিল কয়েকটি বই। সেখানে উল্লেখিত ছিল ফুটি কার্পাসের একটি প্রজাতি থেকেই তৈরি হয় মসলিন। আর সেই ফুটি কার্পাসের ৩৮টি প্রজাতি খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশে।

আরও পড়ুন
খিদে মেটাত মাটির তৈরি বিস্কুট ‘ছিকর’, প্রচলন ছিল প্রতিবেশী বাংলাদেশেই

নমুনা সংগ্রহ করতে ভারতে এসেও সেভাবে লাভ হয়নি গবেষকদের। কারণ ভারতে বর্তমানে যে মসলিন বোনা হয়, তা অনেকটাই রুক্ষ। তৈরি হয় দক্ষিণে উৎপাদিত অন্য একটই তুলোর প্রজাতি থেকে। শেষ পর্যন্ত গবেষকদের পাড়ি দিতে হয় ইংল্যান্ডেই। লন্ডন মিউজিয়ামে বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৩০০টি ঢাকাই মসলিন। সেখান থেকেই ৩০০ বছর আগের তৈরি একটি শাড়ির ডিএনএ সংগ্রহ করেন তাঁরা। তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের ৩৮টি তুলোর প্রজাতির বিশ্লেষণ করে সাফল্য মেলে বিজ্ঞানীদের। খুঁজে পাওয়া যায় কাঙ্খিত তুলা প্রজাতিকে। 

আরও পড়ুন
আঙুলের ছাপ নেই তিন প্রজন্মের – বাংলাদেশেই আছে বিস্ময়কর পরিবার

তবে সেখানেই শেষ ছিল না যুদ্ধের। সেই তুলোর চাষ করে তা থেকে সুতো তৈরি করা ছিল পরবর্তী চ্যালেঞ্জ। গত দু’বছর ধরে চলেছিল হাতা ঘোরানো চরকায় সেই সুতো বোনার কাজ। তৈরি করা হয়েছিল ৫০০ কাউন্ট মসলিন তন্তু। এবার সেই তন্তু দিয়েই দেড়শো বছর পর আবার বাংলাদেশে বোনা হল মসলিন শাড়ি। এখনও পর্যন্ত এমন ছ’টি শাড়ি বোনা হয়েছে বলে জানা গেছে বাংলাদেশ সরকারের সূত্রে। প্রতিটির ক্ষেত্রে খরচ হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। তবে ভবিষ্যতে বেশি পরিমাণ সুতো তৈরি করা গেলে, এই খরচ অনেকটাই কমবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশের গবেষকরা...

আরও পড়ুন
স্বীকৃতির খোঁজে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন, আবেদন জিআই-এর

Powered by Froala Editor