ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত জামাইকার সঙ্গীত বলতে বোঝাত কিংস্টোন। কিন্তু বছরের পর বছর গতানুগতিক সেই সঙ্গীতচর্চা যেন পৌঁছে গিয়েছিল সম্পৃক্ততায়। বদলে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করেছিল মার্কিন সঙ্গীত। হারিয়ে গিয়েছিল জামাইকার নিজস্ব স্বর। ষাটের দশকে রেগে সঙ্গীতের উত্থানই নতুন করে প্রাণসঞ্চার করে জামাইকার সঙ্গীত ইতিহাসে। আর তার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। প্রথাগত বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও, আমাদের পরিপার্শ্বের প্রত্যেকটি জিনিসই যে স্বতন্ত্রভাবে সঙ্গীতের অংশ হয়ে উঠতে পারে— তারই নতুন করে পাঠ দিয়েছিলেন তিনি।
লি ‘স্ক্র্যাচ’ পেরি। রেগে এবং ডাব সঙ্গীতের পথিকৃৎ তো বটেই, বব মার্লের ‘মেন্টর’ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন লি। গত ২৯ আগস্ট ৮৫ বছর বয়সে লুসিয়ার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী তথা সঙ্গীত প্রযোজক। চলতি বছরেই বিদায় নিয়েছিলেন জামাইকার আরেক রেগে কিংবদন্তি বানি ওয়েলার। এবার লি পেরির চলে যাওয়ায় শেষ হল জামাইকার রেগে সঙ্গীতের সোনার অধ্যায়।
১৯৩৬ সালে জামাইকার হ্যানওভারের ছোট্ট শহর কেনদালে জন্ম লি পেরির। আজকের থেকে হ্যানওভারের ছবিটা সেসময় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার সারা গায়ে তখনও পর্যন্ত লেগে দারিদ্র এবং শোষণের ছাপ। এমন একটা পরিস্থিতিতেই বড়ো হয়ে ওঠা তাঁর। তবে সঙ্গীত যে তাঁর জীবনে ঢুকে পড়বে আচমকাই, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তখনও। বাবা-মা দু’জনেই পেশায় শ্রমিক। সামান্য আয়ে পড়াশোনার খরচ চালানোও দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। অল্প বয়সেই তাই বন্ধ হয়ে যায় স্কুলের দরজা। বদলে, বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে ডমিনোস খেলা শুরু করেন পেরি। সেই জুয়া থেকেই মিলত সামান্য হাতখরচ।
পরবর্তীতে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, জুয়া খেলতে গিয়েই মনস্তত্ত্বের গভীর গলিঘুঁজির সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। আর মানুষের মনকে চিনতে শেখার সেই দক্ষতাই নাকি তাঁর সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। জামাইকান যাপনচিত্রে তখন মিশে রয়েছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের দাগ, মাদক সেবনের প্রবণতা আর সমাজ ও পরিপার্শ্বের এক আকস্মিক পরিবর্তন। বাদ্যযন্ত্রের পরিবর্তে সেসব শব্দই হয়ে উঠেছিল তাঁর গানের অঙ্গ। রিকশার হর্ন, গঞ্জিকাসেবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দই হোক কিংবা রহস্যময় নেশাগ্রস্ত উচ্চারণ— এসবই গানে মিশিয়ে দিয়েছিলেন লি পেরি। মোহময়ী সেই আবহের খুব কাছাকাছি যেতে পারে একমাত্র ‘সাররিয়াল’ শব্দটি। কিথ রিচার্ড হয়তো সে কারণেই ‘সঙ্গীতের সালভাদোর দালি’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন জামাইকান তারকাকে।
আরও পড়ুন
প্রয়াত ‘দ্য ওয়েলারস’-এর শেষ সদস্য বানি ওয়েলার, শেষ হল রেজি সঙ্গীতের একটি অধ্যায়
তবে সঙ্গীত জগতে ঢুকে পড়া আর খানিক আকস্মিকভাবেই। পেরির নিজের ভাষায়, রাস্তা থেকেই তিনি সোজা হাজির হয়েছিলেন স্টুডিওতে। একদিন লেবেল স্টুডিও ওয়ানের প্রাণপুরুষ ক্লিমেন্স ডড হাজির হলেন হ্যানওভারের ছোট্ট একটি ডোমিনোসের ঠেকে। লক্ষ্য, স্বল্প পারিশ্রমিকে সহকারীর খোঁজ। পেরিকে প্রস্তাব দেওয়ার পর রাজিও হয়ে যান তিনি। শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
আরও পড়ুন
বিক্রি হয়ে গেল বব ডিলানের লেখা সমস্ত গানের স্বত্ব
ডডের সঙ্গে অবশ্য খুব বেশিদিন সুসম্পর্ক ছিল না পেরির। মতপার্থক্যের জেরেই স্টুডিও ত্যাগ। তারপর শুরু হয় স্বতন্ত্র যাত্রাপথ। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রেকর্ডিং ‘দ্য চিকেন স্ক্র্যাচ’। অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল জামাইকাজুড়ে। সেই গানের দৌলতেই ‘স্ক্র্যাচ’ উপাধিও পান পেরি। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের ৪৪ বছর পরে ক্ষমাপ্রার্থনা; বব ডিলান ও এক সঙ্গীতময় সম্পর্কের আখ্যান
ডডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর বেশ কিছুদিন জামাইকান সঙ্গীত প্রযোজক জো গিবসের সঙ্গেও কাজ করেন পেরি। ওয়েলার, বব মার্লের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় সে সময়েই। বব মার্লের সঙ্গীতসজ্জাকে অনন্য করে তোলার নেপথ্য অন্যতম কারিগর তিনি। কিন্তু অন্যের রেকর্ডিং স্টুডিও-তে কোথাও যেন নিজের পরীক্ষামূলক সঙ্গীত সৃষ্টির স্বাধীনতাকে হারিয়ে ফেলছিলেন পেরি। আর সেই স্বাধীনতার সন্ধানেই ১৯৭৩ সালে নিজস্ব স্টুডিও স্থাপন করেন ‘স্ক্যাচ’। তাঁর ‘ব্ল্যাক আর্ক’ স্টুডিওতে পরবর্তীতে রেকর্ড হয়েছে স্ট্রিংস সহ, রিটার্ন অফ জ্যাঙ্গো, ক্লিন্ট ইস্টউড, দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড অপসেটারস-সহ একাধিক যুগান্তকারী অ্যালবাম।
কিন্তু ওই যে সাররিয়াল, ওই যেন খামখেয়ালিপনা। মাত্র ১০ বছর যেতে না যেতেই নিজের স্বপ্নের স্টুডিওতেই স্বয়ং অগ্নিসংযোগ করেছিলেন লি পেরি। চোখের পলকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন নিজের সাজানো ইমারত। কেননা, উপার্জনের স্বার্থে রেগে সঙ্গীতের বাইরেও তাঁকে অন্যান্য গানের কাজ করতে হচ্ছে। আর তা নাকি খোদ শয়তানের উপাসনা। যদিও সঙ্গীতজগৎ থেকে বিদায় নেননি তিনি এর পরেও। কাজ করেছেন অন্যান্য স্টুডিওতেও। চূড়ান্ত সাফল্যও আসে শেষ বয়সে। ২০০৩ সালে তাঁর জামাইকান ইটি অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি পুরস্কার পান পেরি।
জামাইকান সঙ্গীতের জগতে তাঁর মতো খামখেয়ালি ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয় কেউ এসেছে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা অচলতে পারে। একাধিক পুরস্কার হয়তো ঝুলিতে নেই তাঁর, জনপ্রিয়তার শীর্ষ তালিকাতেও নেই তিনি, কিন্তু তাঁর অদ্ভুত ব্যক্তিত্বই বাকিদের থেকে অনন্য করে তুলেছিল তাঁকে। পরিবর্তন এনে দিয়েছিল একটা সঙ্গীতের ধারায়। সেই সোনালি অধ্যায়েই ইতি পড়ল তাঁর বিদায়ে…
Powered by Froala Editor