নতুন দশকে পা দিয়েছে পৃথিবী। কিন্তু কিছু চিরন্তন সমস্যার হাত থেকে মুক্তির খোঁজ নেই এখনও। এই কঠিন সময়ে আরো একটা খবর নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। যে বয়স আদতে বেড়ে ওঠার বয়স সে বয়েসেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছে কয়েক হাজার শরণার্থী শিশু, কিশোর-কিশোরী। হ্যাঁ, এক নিষ্ঠুর সত্যির মুখোমুখি গোটা দুনিয়া।
তুরস্কের উপকূলে গ্রিসের একটা ছোট দ্বীপ লেসবস। বিখ্যাত কবি সাফোর জন্মস্থান হিসেবে খ্যাত লেসবস। ২,০০০ শরণার্থীদের জন্য একটা ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল সেখানে। আজ সেখানে ১৮,০০০ অভিবাসীর বাস। তাদের মধ্যে প্রায় ৭০০০ জনই শিশু। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে এসেছে এরা প্রত্যেকেই। কিন্তু ভয়ের বিষয়, এই ৭-৮ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে বেড়ে চলেছে এক অদম্য মৃত্যু প্রবণতা। ছোট ছোট এইসব শিশুদের জন্যই একটি স্কুল তৈরি করা হয়েছে ক্যাম্পের মধ্যেই। যদিও এটি অস্থায়ী। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত এই সব শিশুদের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন জেকরিয়া ফারহাদ। তিনিও শরণার্থী। এই মৃত্যু উপত্যকাতে মরূদ্যান হয়ে উঠেছেন তিনি। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে অস্থায়ী স্কুল তৈরির জায়গা পেয়েছেন জেকরিয়া। তাঁর স্কুলে ছবি আঁকা, ভাষা, গান শেখাচ্ছেন নিয়মিত। যারা শিখছে অধিকাংশই আত্মহননের দিকে হেঁটে চলা বিষাদগ্রস্ত শিশু-কিশোর। প্রায় ১০০০ শরণার্থী শিশু এখানে ক্লাস করছে ২০ জন শিক্ষকের কাছে। জীবনের মূল স্রোতে ফেরৎ আনার এই যে চেষ্টা তাও কার্যত নজিরবিহীন।
হঠাৎ করেই নিজের দেশ যদি আমাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে কী হবে আমাদের? জানি না আমরা। জানত না এরাও। ক্যাম্পের মধ্যেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শৈশব কাটছে মুস্তাফা, নার্গিস, ফারুকের মতো শিশুদের। যেখানে ন্যূনতম খাবার, ডাক্তার পরিষেবাটুকুও নেই। একের পর এক অসহনীয় দিন আত্মহননের বীজ বুনেছে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীর মনে। বিগত তিন মাসেই প্রায় ২০টি ঘটনা ঘটেছে এমন। একা হাতে দুটো আত্মহত্যার চেষ্টার মোকাবিলা করেছেন এক মনোবিজ্ঞানী।
আতঙ্ক এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। একটু চোখের আড়াল হতেই দেওয়ালে মাথা ঠোকা থেকে চুল টেনে নিজেই নিজেকে কষ্ট দেওয়া। আরো ভয়াবহ যে এরা কেউ কেউ হাত কেটে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। যে বয়স শেখার, খেলে বেড়ানোর সেই বয়সে তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা জানিয়ে দিচ্ছে প্রকাশ্যে। আদতে কেউ তো নিজের ভিটে ছেড়ে আসতে চায় না। আর শরণার্থীর জীবন যে কতটা ভয়ংকর তা চেনাচ্ছে গ্রিসের এই দ্বীপ। এমনকি অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তীব্র শীতে শিশুদের গরম জামা কাপড়ের ব্যবস্থাও নেই এখানে। নেই পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থাও। অসুখের প্রকোপও নিত্য বেড়ে চলেছে লেসবসে।
গ্রিক সরকার নতুন বছরের শুরুতেই ২০,০০০ শরণার্থী অভিবাসীকে লেসবস থেকে মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে তা আদৌ কার্যকর হবে কিনা জানা নেই। গ্রিস তাদের এই সঙ্কটে পাশে দাঁড়ানোর আবেদন করেছে বাকি ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে। সবমিলিয়ে এক মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত আগামী প্রজন্ম তীব্র যন্ত্রণায় মুক্তির দিন গুনছে।