যতদূর থেকে যায় শুধু জল আর জল। আদিগন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে হাজির হয়েছে বিশালায়তন বেশ কয়েকটি জাহাজ। সমুদ্র জুড়ে জাল বিছিয়ে দিচ্ছে তারা। কিন্তু মাছ ধরার জন্য ট্রলার ছেড়ে জাহাজ? ব্যাপার কী? না, মাছ ধরতে নয়। বরং, সমুদ্রে ভাসমান আবর্জনার স্তূপ পরিস্কার করতেই হাজির হয়েছে এই জাহাজগুলি।
গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ (Great Pacific Garbage Patch)। প্রশান্ত মহসাগরে (Pacific Ocean) ভাসমান এই আবর্জনার দ্বীপ বার বার উঠে এসেছে চর্চায়। যা পরিচিত প্রশান্ত মহসাগরীয় আবর্জনার ঘূর্ণি নামেও। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যবর্তী এই অঞ্চলটিতে সমুদ্রস্রোতের কারণে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয় বলেই প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ এসে জমা হয় সমুদ্রের এই অংশে। আর আবর্জনার স্তূপ জমতে জমতেই আস্ত একটি দ্বীপ তৈরি হয়েছে সেখানে।
চলতি শতকের শুরু থেকেই একাধিক পরিবেশ সম্মেলনে উঠে এসেছে এই গারবেজ প্যাচ পরিষ্কার করার প্রস্তাব। পদক্ষেপ যে কিছুই নেওয়া হয়নি এমনটা নয়। তবে আন্তর্জাতিক শক্তিদের উৎসাহে খামতি তো রয়েছেই। এবার সেই খামতিই পূরণ করল নেদারল্যান্ডসের অলাভজনক সংস্থা ‘দ্য ওসান ক্লিনআপ’। চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রায় ১ লক্ষাধিক কেজি প্লাস্টিক অপসারণ করল আন্তর্জাতিক পরিবেশ গোষ্ঠীটি। যা প্রায় দুটি বোয়িং-৭৩৭ বিমানের মোট ওজনের থেকেও বেশি।
উল্লেখ্য, এর আগে কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই অপসারণ করা হয়নি এত পরিমাণ বর্জ্য। তবে গতবছর আগস্ট মাসে ৪৫টি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ থেকে সরানো হয়েছিল ১,০১,৩৫৩ কেজি বর্জ্য। সেই রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেল ‘দ্য ওসান ক্লিনআপ’-এর উদ্যোগ। তাদের সংগ্রহ ১,০৮,৫২৬ কেজি প্লাস্টিক। যা এক নতুন নজির।
তবে এই কৃতিত্বের পরেও উচ্ছ্বসিত নন ‘দ্য ওসান ক্লিনআপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা বোয়ান স্লাট। তাঁর অভিমত, এই অভিযানে কেবলমাত্র সরানো হয়েছে মোট আবর্জনা স্তূপের মাত্র হাজার ভাগের এক ভাগ। প্রশান্ত মহাসাগরের এই আবর্জনার স্তূপকে সম্পূর্ণভাবে সরানো বা সেখানকার প্রকৃতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কোনো অলাভজনক সংস্থার পক্ষেই সম্ভব নয়। বরং, তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিকে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সমীক্ষা অনুযায়ী, গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচের প্রায় ৯০ শতাংশ বর্জ্যই বিয়োজনে অযোগ্য। অর্থাৎ তা মূলত প্লাস্টিক, নাইলন জাতীয় পদার্থের। ফলে, ক্রমেই বেড়ে চলেছে এই আবর্জনার স্তূপের পরিমাণ। এমনকি এই স্তূপই বর্তমানে হয়ে উঠেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সবচেয়ে বড়ো আধার। তবে একবার এই আবর্জনার পাহাড় সরিয়ে ফেলাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। তার কারণ সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই নতুন পরিবেশকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন বাস্তুতন্ত্র। প্রচুর জলজ প্রাণী ও অণুজীব অভিযোজিত হয়ে গেছে এই পরিবেশে। হঠাৎ এই বর্জ্য-দ্বীপের উপস্থিতি মুছে গেলে বিপন্ন হয়ে যাবে তারাও। যদিও সার্বিকভাবে তা যে পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। গবেষণা চলছে পৃথিবীর সব প্রান্তেই। এখন দেখার দু’দিক সুরক্ষিত রেখেই বিজ্ঞানীরা দূষণ রোধের উপায় খুঁজে বার করতে পারেন কিনা…
Powered by Froala Editor