১৯৮২ সাল। কেরলের নির্বাচনে হঠাৎ পরীক্ষামূলক একটি সিদ্ধান্ত নিল সরকার। আর ব্যালট পেপার নয়। এবার ভোট হবে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের মাধ্যমে। হ্যাঁ, আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে পৃথিবীতে প্রথমবারের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল ইভিএম। যদিও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ ব্যবহার শুরু হয় ২০০২ সালে। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও দুই দশক। কিন্তু বিষয় হল এর পরেও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারত ছাড়া ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, কাজাকাস্থান, কেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, স্কটল্যান্ডের মতো— মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশেই ব্যবহৃত হয় ইভিএম।
এই জায়গাটাতেই থেকে যায় প্রশ্ন। চলতি শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে আমূল পরিবর্তন হয়েছে প্রযুক্তির। কিন্তু তারপরেও কেন ইভিএম ব্যবহারের পরিপন্থী অধিকাংশ দেশ? ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ব্রিটেনও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ইভিএমের থেকে। না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে কোনো ইভিএম পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়নি সেখানে। জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডস সরকারিভাবে ইভিএমের ব্যবহার চালু করেও ফিরে গেছে ব্যালটে। এই অনাস্থার কারণ ঠিক কী?
জার্মানির বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক। সে দেশের সংবিধান মনে করিয়ে দিচ্ছে একটি অতি-পরিচিত আইনের কথা। রাইট টু নো অ্যাক্ট বা আরটিআই। যা রয়েছে আমাদের দেশেও। জার্মান সাংবিধানিক আদালতের মতে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক কী পদ্ধতি মেনে হচ্ছে তা সম্পূর্ণ পরীক্ষা করে দেখার অধিকার রয়েছে নাগরিকদের। আর সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য ট্রায়ালে অংশ নিতে পারেন যে কোনো মানুষ। কিন্তু গোটা পদ্ধতিটা যদি ইভিএমের মাধ্যমেই হয় তবে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগটা কোথায়, যে কম্পিউটারাইজ এই প্রোগ্রামিং বা অ্যালগোরিদম পুরোপুরি স্বচ্ছ? এই কারণেই ইভিএম ব্যবহার শুরু করেও পিছিয়ে এসেছে জার্মান সরকার।
জার্মানির কথা সরিয়ে রেখে অন্যান্য প্রজাতান্ত্রিক সরকারগুলোর দিকে দেখা যাক। আয়ারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডস— সেখানেও বাতিল হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। এসব দেশের প্রশাসনের বিশ্বাস, এখনও পর্যন্ত দেশের সমস্ত নাগরিকদের কাছে পৌঁছে যায়নি প্রযুক্তি এবং শিক্ষার আলো। ফলে কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সঙ্গে ততটাও সড়গড় নন তাঁরা। কাজেই কোনো গোলযোগ সহজেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে তাঁদের। শিক্ষার হার ১০০ শতাংশ হলে তবেই এই ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে জাতীয়স্তরে। আর ঠিক এই জায়গাটায় ভারত?
আরও পড়ুন
এশিয়ার একমাত্র ভোটের কালি তৈরির কারখানা ভারতেই!
বিশ্বের মোট নিরক্ষরের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের নাগরিক। অথচ সেই প্রসঙ্গ একবারও উঠে আসছে না। কিংবা এলেও তার স্বপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে। কী সেই যুক্তি? বলা হচ্ছে ভারতে যে ইভিএম ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে যোগ থাকে না ইন্টারনেটের। ফলে বাইরে থেকে হ্যাকিং সম্ভব নয় এই যন্ত্রের। তাছাড়াও ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করে দেখা হয় মেশিনগুলিকে। কাজেই তার ওপর অনাস্থার কোনো কারণ নেই সাধারণ মানুষের। নাগরিকদের যন্ত্রের স্বচ্ছতা যাচাই কিংবা পর্যবেক্ষণের অধিকারকেই কোথাও কি খাটো করে দেখা হচ্ছে এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই? এ প্রশ্ন থাক পাঠকের কাছেই।
এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো নির্বাচনবিদ ম্যাক্সিমিলিয়ন এবং কর্নেলিয়াস হারস্যাটের গবেষণার কথা। “ইন্ডিয়া’স ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন” থেকে কোট আনকোট তুলে আনা যাক কয়েকটি লাইন— “অন্যান্য দেশের মতো দামি, জটিল এবং কম্পিউটারাইজড হয় না ভারতের ইভিএম। তা যথেষ্ট সরল, স্বল্পমূল্যের এবং কার্যকরী। ইলেকশন কমিশন এই যন্ত্রের গর্ব করলেও, সবথেকে বেশি যান্ত্রিক গোলযোগের দৃষ্টান্তও এসেছে এই যন্ত্র থেকেই।” আবার কোথাও বলা হচ্ছে, “অত্যন্ত সহজ হওয়ার কারণেই এতে থেকে যায় যান্ত্রিক কারসাজি করে রাখার সুযোগও।”
আরও পড়ুন
চিনেভাষায় 'খেলা হবে', ভোটের দেওয়াল জুড়ে 'চিনে কলকাতা'
হ্যাকিং-এর প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন ফ্রান্সের কথা বলে রাখা ভালো। সেখানে স্রেফ হ্যাকিং-এর সম্ভাবনার জেরেই বাদ দেওয়া হয়েছে ইভিএম। ভোট প্রক্রিয়া হয় অনলাইন মাধ্যমেই। তবে তা সত্ত্বেও যন্ত্রে ‘না’ বলেছে ফরাসি সরকার। তার অন্যতম কারণ হল যন্ত্রগুলি কোনো সরকারি সংস্থা প্রস্তুত করে না। সম্ভবও নয়। থার্ড পার্টি সংস্থার ওপরেই নির্ভর করতে হয় ইভিএমের জন্য। গণ্ডগোল যে সেখানেও হচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কি আছে? হতেই পারে সেই সংস্থাকে হাত করেই ক্ষমতা কায়েম করেছে কোনো হ্যাকার কিংবা কোনো রাজনৈতিক দল।
ঠিক এমনটাই অভিযোগ উঠেছিল এস্তোনিয়ায়। সেখানে নির্বাচন হয় হুবহু ভারতীয় পদ্ধতিতে। ইভিএমও এদেশের মতোই। ইন্টারনেট নেই তাতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছর কয়েক আগেই দাবি উঠেছিল ভোট-জালিয়াতির। ক্ষমতাসীন সরকার ও ইভিএম প্রস্তুতকারক সংস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকেই উঠেছিল আঙুল। ভেনেজুয়েলায় ছাপ্পা রুখতে চালু হয়েছিল ইভিএমের সঙ্গে বুড়ো আঙুলের ছাপ স্ক্যান করার এক যন্ত্র। তার মধ্যেও কারসাজির অভিযোগ উঠেছিল ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশে।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম ভোটদাতা তিনি, ১০৩ বছরেও 'দায়িত্ব' ভোলেননি শ্যামস্মরণ নেগি
বাংলায় প্রথম দফার নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে ইতিমধ্যেই। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ছবি যেমন সামনে এসেছে রাজ্যজুড়ে, তেমনই উঠে এসে বহুদিনের এক বিতর্কও। অভিযোগ, ইভিএম কারছুপির। যে কোনো বোতাম টিপলেই কোনো একটি নির্দিষ্ট দলেই ভোট চলে যাচ্ছে বলেই দাবি করেছেন মাজনার সাধারণ মানুষ। তবে এই কি প্রথম? এর আগেও ভারতে ইভিএম বিতর্কের উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি।
শুধু বাংলার দিকেই বিগত ৭ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে একাধিকবার উঠেছে এমন অভিযোগ। তাছাড়াও চলতি নির্বাচনের প্রথম দিনে ভোট শুরুর ১ ঘণ্টার মধ্যে কাজ করা বন্ধ করেছিল ৯০টির বেশি ইভিএম। গোটা বিষয়টির স্বপক্ষে কী পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন? বলা হচ্ছে পাল্টে দেওয়া হয়েছে যন্ত্রগুলিকে। এটাই তবে সমাধান? নির্বাচনের আগে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও এমন ত্রুটি একটিবারও নজরে এল না তাঁদের? এমন যুক্তি সত্যি কি গ্রহণযোগ্য?
পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি বিষয়। ইভিএমের ভোট গণনার সময় নিশ্চিত হয়ে যায় ঠিক কোনো অঞ্চলের বা কোনো বুথের মানুষ ঠিক কোন দলকে ভোট দিয়েছেন। যা ব্যালটের ক্ষেত্রে হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেখানে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় সমস্ত ভোট। তারপর শুরু হয় গণনা। এক্ষেত্রে কোনো একটি অঞ্চলের মানুষদের ওপর সার্বিকভাবে প্রভাব পড়তে পারে রাজনৈতিক নেতাদের। ইতালি কিংবা স্পেনের মতো দেশগুলিতে কিন্তু এই প্রসঙ্গটাকেও মাথায় রেখেই বাদ দেওয়া হয়েছে ইভিএমকে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে প্রতিনিয়তই উঠতে বসতে রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সেখানে ইভিএমের ব্যবহার যে বাড়তিভাবে মেরুকরণে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে তাতে আর সন্দেহ কই?
কিন্তু এসবের পরেও সচেতনতা কিংবা সাংবিধানিক বদল— কোনোটাতেই কোনো আগ্রহ দেখাতে ইচ্ছেপ্রকাশ করেনি নির্বাচন কমিশন। দাবি ভারতের মতো জনবহুল দেশে ভোট গণনায় তবে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। সময় যে লাগবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে এখানে বলে রাখা যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। সদ্য শেষ হওয়া প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের স্মৃতি সকলের কাছেই ঝকঝকে। সেখানে শুধু ভোট গণনা চলেছিল টানা ২ দিন ধরে। গণনা করা হয়েছিল গোটা দেশের মানুষের ব্যালট এবং পোস্টাল ভোট। তবে ভারতে নির্বাচনের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে একইসঙ্গে কিন্তু সারা দেশের ভোট গণনা হয় না। সুতরাং, জনসংখ্যা বেশি হলেও গণনার সেই ব্যাপক চাপ অনুপস্থিত এ দেশে। তা সত্ত্বেও সেই একই যুক্তি দিয়ে কেন ইভিএমের পক্ষে সরকার— তা নিয়েই থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। আদৌ কি তার বদল আসবে অদূর ভবিষ্যতে?
Powered by Froala Editor