“এ বছরের দুর্গাপুজো আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। পাঁচ মাসের বন্ধ ব্যবসা যদি আবার চাগিয়ে তোলা যায়, তাহলে আবার আগামী বছরের জন্য স্বপ্ন দেখতে পারব।” বলছিলেন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী বাবু পাল। প্রতি বছরের মতো আবারও ব্যস্ততায় সেজে উঠেছে গোটা এলাকা। সামনে যে দুর্গাপুজো। মা-কে তাই সাজিয়ে তুলতে হবে এর মধ্যেই। কিন্তু কিছুদিন আগেও শিল্পীরা কেউই নিশ্চিত ছিলেন না আদৌ এই সময় কোনো কাজ পাবেন কিনা। মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতির সম্পাদক সুজিত পালের কথায়, “পুজো যে বন্ধ হবে না সেটা তো আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো বায়না আসেনি। অন্য বছর যেখানে প্রায় ৫-৬ মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করি, এবছর সেখানে বায়না আসতে শুরু করে ১৫ আগস্টের পর থেকে।” আর এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে বাসন্তী পুজো, শীতলা পুজোর মতো অনুষ্ঠান। হাত গুটিয়ে বসেই ছিলেন শিল্পীরা।
ক্যালেন্ডার বলছে, এ-বছর ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী, বাঙালির মহোৎসবের শুভারম্ভ। আগামীকাল মহালয়া। অন্যবছর এই সময় দেবীর চক্ষুদান সম্পন্ন হয়ে যায়। যদিও এবছর আশ্বিন মলমাস হওয়ায় পুজোর দেরি আছে। কিন্তু কুমোরটুলির সার্বিক চেহারা মন্দার দিকেই। সুজিত পাল জানালেন, “প্রতি বছর যেখানে প্রায় ৪৫০০ থেকে ৫০০০ প্রতিমা তৈরি হয়, এবছর সেখানে এখনও অবধি ২৫০০ প্রতিমা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটা হয়তো ৩০০০-এ দাঁড়াবে। কিন্তু আগের মতো ব্যবসা আশা করা যাচ্ছে না।”
দুর্গাপুজো মানেই বাংলায় সাজো সাজো রব। শহর ও শহরতলির বাঁশ বাঁধা, বড় বড় হোর্ডিং টাঙানো অথবা প্যান্ডেল প্ল্যানিং চলতে থাকে। বাজার দোকানে উপচে পড়া ভিড়, রাস্তায় নিয়মিত জ্যাম এসব মিলিয়ে এক হইহই কাণ্ড। আর এই এত আড়ম্বরের মধ্যমণি যিনি, তিনি স্বয়ং দুর্গাপ্রতিমা। বাঙালির আবেগকে একটু একটু করে রূপ দেন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কথিত আছে শাপভ্রষ্ট বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচী পৃথিবীতে ছিলেন কিছুকাল। তখন তাঁদের নয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রত্যেক সন্তানকে বিশেষ বিশেষ শিল্পের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। তাঁদেরই একজন কুম্ভকার। আর মজার ব্যাপার, এই করোনা পরিস্থিতিতে কিন্তু এই বিশ্বকর্মা পুজোর সূত্রেই প্রথম উপার্জনের মুখ দেখলেন তাঁর সন্তানরা।
আরও পড়ুন
দেশের দীর্ঘতম বুদ্ধমূর্তি তৈরি হচ্ছে কুমোরটুলিতে, অনন্য নজির মৃৎশিল্পী মিন্টু পালের
বাঙালির বারো মাসে তেরো চোদ্দটা পার্বণ লেগেই থাকে। আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে অসংখ্য কুম্ভকারের জীবিকা। কিন্তু এবছর বাসন্তী পুজোর সময় থেকেই আর কোনো উপার্জন ছিল না। তবে বিশ্বকর্মা পুজোয় ব্যবসা আবার চালু হওয়ায় একটা খুশির হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্পী বাবু পাল বললেন, “এই তো শুরু হল। এরপর দুর্গাপুজো যদি ঠিকভাবে সামলে নেওয়া যায় তাহলে আগামীতে লক্ষীপুজো, কার্তিক পুজো, জগদ্ধাত্রীপুজোতে বেশ কিছুটা লাভ হতে পারে। আর কালীপুজো তো আছেই।” তবে বড়ো বড়ো প্রতিমার বরাত এবছর মেলেনি। “৭০ শতাংশ ক্রেতাই একচালা মূর্তির বায়না দিয়ে গিয়েছেন।” বললেন সুজিত পাল। আর প্রতিমার দাম যেহেতু তার আকারের উপরেই নির্ভর করে, তাই আয়ও কমেছে সমান ভাবে।
আর্থিক লোকশানের একটা খতিয়ানও পাওয়া গেল শিল্পীদের কথায়। এই ৫ মাস প্রত্যেক শিল্পীর আয় শূন্য। অন্যান্য বছরে যেখানে এর মধ্যেই ৫০ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন কুমোরটুলির সমস্ত শিল্পী। আর দুর্গাপুজয় প্রত্যেক শিল্পীই গড়ে ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। এবারে সেই অঙ্কটা হাজারের ঘর অতিক্রম করবে বলে মনে করছেন না অনেকেই। অতএব সামগ্রিকভাবে এই শিল্প এলাকাটির অর্থনীতি এখন অনিশ্চয়তার সুতোয় ঝুলছে। তবুও অন্য কোনো জীবিকার সন্ধানে যেতে পারছেন না তাঁরা। বাবু পালের কথায়, “এই করেই তো এত বছর বেঁচে আছি। অন্য কী কাজ করব? আর এই পরিস্থিতিতে লাভের আশা কোথায়?”
আরও পড়ুন
লকডাউন ও আমফানের জোড়া ধাক্কায় ধ্বস্ত কুমোরটুলি, এগিয়ে এলেন তরুণ-তরুণীরা
প্রতিমাকে ঘিরে ব্যবসাও যেমন নেই, নেই পুজোর জৌলুসও। কুমোরটুলির ঐতিহ্যপ্রাচীন সার্বজনীন পুজোও এবারে দেখা যাবে না সেই আগের চেহারায়। “২৫-৩০ বছর আগে যেমন সাদামাটা পুজো হত, তেমনই হবে।” জানালেন সুজিত পাল। আর এসবের মধ্যেই আছে টিকে থাকার এবং টিকিয়ে রাখার লড়াই। আজকের শিল্পীরা হাল ছেড়ে দিলে হয়তো কলকাতার ঐতিহ্যই হারিয়ে যাবে। আর কখনোই দেখা যাবে না কুমোরটুলির ব্যস্ত চেহারা। সেই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন শ-খানেক শিল্পী। এই বিশ্বকর্মা পুজো সাক্ষী থাকল দেবতার সেই সন্তানদের মরণপণ লড়াইয়ের। এই লড়াইয়ের মধ্যেই ধীরে ধীরে প্রাণ পাক কুমোরটুলি। বাঙালির নস্টালজিয়া আগলে রাখুক তার ঐতিহ্যের উষ্ণতাটুকু।
আরও পড়ুন
প্যাকিং হয় দুর্গারও, কুমোরটুলি থেকে বিমানে চেপে পাড়ি দেন বিদেশে
Powered by Froala Editor