“অবশেষে ন্যাপলস থেকে বিদায় নিল নাৎসি বাহিনী। ইতালির এই শহর অক্ষশক্তির ক্ষমতায় ফিরলেও, জার্মান সেনাদের রেখে যাওয়া টাইম বোম্বের বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ন্যাপলস-এর সেন্ট্রাল পোস্ট অফিস।”
টুইটটি করা হয়েছে চলতি বছরের ৮ অক্টোবরে। সন্ধে ৮টা নাগাদ। ইতালিতে তখন সকাল। তবে কি ভয়াবহ যুদ্ধে কেঁপে উঠল ইউরোপের মাটি? জার্মানি(Germany), অক্ষশক্তি, নাৎসি বাহিনী (Nazis), বিস্ফোরণ— প্রতিটা শব্দবন্ধে চোখ পড়তেই নিশ্চয়ই এই প্রশ্নই বার বার জেগেছে মনে? তেমন মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক। কারণ, একটি বিক্ষিপ্ত কোনো টুইট নয়। টুইটারের এই পাতাটি স্ক্রল করলেই, দেখা মিলবে সারাদিনে টুইট করা একাধিক পোস্ট। আর তার প্রত্যেকটিতেই উঠে এসেছে বিধ্বংসী যুদ্ধের ভয়াবহতা।
না, আদতে কোনো যুদ্ধ চলছে না। বরং, স্মৃতিচারণা হচ্ছে যুদ্ধের। আরও ভালো করে বলতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ফেসবুকের দৌলতে ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘মেমোরি’-র খেলা। ২০১৪ সালে আজকের তারিখে আপনি ফেসবুকের পাতায় কী লিখেছিলেন বা কোন ছবি পোস্ট করেছিলেন তা মনে করিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়া জায়েন্টটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই যুদ্ধের টুইটও অনেকটা সেরকমই। তারিখ এবং সময় মেনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘লাইভ’ ধারাবিবরণী চলে টুইটারের ‘রিয়েলটাইমডব্লুডব্লু২’ (@RealtimeWWII)-পেজে।
খোদ টুইটার কিংবা কোনো ঐতিহাসিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয়, এই ধারাবিবরণীর একক উদ্যোক্তা লন্ডন মিউজিয়ামের কিউরেটর অ্যালভিন কলিনসন। আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের কথা। ২০১১ সাল সেটা। বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধান তাঁর কাছে একপ্রকার নেশার মতো ছিলই। তবে মূলত ইতিহাসের প্রতি সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে তুলতেই বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে টুইট করার সিদ্ধান্ত নেন কলিনসন। ওই বছর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর কর্মযজ্ঞ। কলিনসনের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০১১ সালটাই হয়ে ওঠে ১৯৩৯-এর প্রেক্ষাপট। প্রাথমিকভাবে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকেই পোস্ট করতেন কলিনসন। পরে তিনি গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ পৃথক একটি টুইটার পেজ।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কলকাতা হয়ে তিব্বতে নাৎসিরা, কী ছিল উদ্দেশ্য?
তবে তাঁর গল্প দৈনিক ইতিহাসচারণ। ফলত, ২০১৭ সালেই ফুরিয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬ বছরের মেয়াদ। কিন্তু তারপরেও থেমে থাকেননি কলিনসন। বা, আরও ভালো করে বলতে গেলে থেমে যেতে পারেননি। আর তার অন্যতম কারণ হল অনুরাগীদের অনুরোধ। বলাই বাহুল্য, তাঁর এই অভিনব উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। ফলোয়ারের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৫ লক্ষের গণ্ডি। ফলত, তাঁদের অনুরোধ রেখে, ওই একই বছর থেকে ফের বিশ্বযুদ্ধের ধারাবিবরণী দেওয়া শুরু করেন কলিনসন। যা চলছে এখনও। তাঁর ‘রিয়েলটাইমওয়ার্ল্ডওয়ার২’ পেজে এখন ১৯৪৩ সাল।
আরও পড়ুন
কলকাতার মার্কিন সেনা, ‘নরখাদক’ কৃষ্ণাঙ্গ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলি
তবে শুধু পুরনো টুইটের পুনর্ব্যবহারই নয়, পাশাপাশি আরও ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাও তিনি ক্রমাগত সংযোজন করে চলেছেন তাঁর সাম্প্রতিক টুইটে। দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে লেখা অজস্র চিঠি, ডায়েরির পাতার অংশ। সেইসঙ্গে দৈনিক সংবাদপত্রের আর্কাইভ থেকে ছোটো ছোটো অজস্র কাটআউট এবং উদ্ধৃতি। সব মিলিয়ে এই পেজে ঢুকে পড়লে মনে হবে সত্যিই যেন সময়টা পিছিয়ে গেছে সাড়ে সাত দশক।
আরও পড়ুন
শত্রুপক্ষকে একা হাতে সামলে বিশ্বযুদ্ধের 'নায়ক' এই পর্তুগিজ সৈন্যই
কিন্তু শুধু অনুরাগীই নয়, তাঁর এই উদ্যোগের জন্য একইসঙ্গে বহু মানুষের চক্ষুশূলও হয়ে উঠেছেন কলিনসন। তাঁর প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছে নিও-নাজি বা নব্য-নাৎসিরা। কখনো আবার ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে ব্রিটিশ সেনাদের লজ্জাজনক হারের কথা তুলে আনায়, ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে নিজের দেশের নাগরিকদেরই। সমালোচনাও কম হয়নি তাঁকে নিয়ে। কখনো আবার তাঁর টুইটকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিক্ষোভ ছড়ানোর চেষ্টাও চলেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও অবিচল কলিনসন। অতীতকে অস্বীকার করার বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলেই বিশ্বাস তাঁর।
এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কতটা পরিশ্রম কিংবা গবেষণা জড়িয়ে রয়েছে— তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চাইলে যে নিজের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারতেন কলিনসন। তবে সেই পথে না গিয়ে নিছক সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেওয়া— কম কথা নয়। তাঁর এই একক উদ্যোগকে কুর্নিশ জানানোর মতো ভাষাও যেন কম পড়ে যায়।
Powered by Froala Editor