‘আমরা পাঁচজন ছিলাম মানিকদার হাতের পাঁচ আঙুল’ – বলেছিলেন রূপশিল্পী অনন্ত দাশ। পাঁচজন বলতে ক্যামেরাম্যান, এডিটর, ফটোগ্রাফার, সেট ডিজাইনার আর মেকআপ আর্টিস্ট। এঁদের মধ্যে মেকআপ আর্টিস্ট-এর কাজের পরিসর বোধহয় আপাতদৃষ্টিতে খুবই কম – কিন্তু তাঁর কলাকৌশলের গুরুত্ব অসীম। মানুষের ছ’ইঞ্চি/ছ’ইঞ্চি মাপের মুখটুকুই ছিল তাঁর ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে তিনি ফুটিয়ে তুলতেন চরিত্রের উপযোগী নানা মুখভাবের ছবি। নিছক মেকআপ ম্যান নন, ‘মেকআপ আর্টিস্ট’এর সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি সেসময়কার ইন্ডাস্ট্রিতে।
অন্যান্য ছবিতে কাজ করতেন পেশাদারি মেজাজে, কিন্তু ‘মানিকদা’র ইউনিটে কাজ করতেন প্রাণের আনন্দে। অল্পবয়সেই নামতে হয়েছিল জীবনযুদ্ধে, প্রথাগত পড়াশোনা বেশিদূর হয়ে ওঠেনি সে কারণেই। কিন্তু শেখার আগ্রহের কোনো অভাব ছিল না। কাজের প্রয়োজনে কঠিন কোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার দরকার হলে পিছিয়ে যেতেন না, বরং উপযুক্ত লোকের কাছে গিয়ে বলতেন – ‘এখানটা একটু বুঝিয়ে দিন তো।’ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে ‘ভাল রাজা’ আর ‘দুষ্টু রাজা’র চরিত্রে সন্তোষ দত্তের দ্বৈত অভিনয় মনে পড়ে? মেকআপে সেই দ্বৈত সত্তার রূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনন্ত। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এ ছোরা-খেলোয়াড় অর্জুনের ভূমিকায় কামু মুখোপাধ্যায়ের সেই মেকআপ, মছলিবাবার ছদ্মবেশে ফেলুদা, ‘অশনি সঙ্কেত’-এ যদুর পোড়া মুখ – তার পেছনেও অনন্তের হাত। কাজ করেছিলেন অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গেও – ‘নিধিরাম সর্দার’, ‘নীল আকাশের নিচে’-র মতো ছবির রূপসজ্জাতেও স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর কাজ।
ছবি আঁকিয়ে হবেন বলে ভেবেছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত, কিন্তু হয়ে গেলেন বন্ধু সত্যজিতের সেট ডিজাইনার। সত্যজিতের ছবির সেট জীবন্ত হয়ে উঠত তাঁর হাতের কাজে। নিমতিতার জমিদার বাড়ির বাইরেটা দেখানো হল আসল, কিন্তু বিশ্বম্ভর রায়ের সেই বিখ্যাত নাচঘর বংশীর হাতে গড়া। নায়কের ট্রেনের কামরার সেট, কাশীতে হরিহরের বাসার ভেতরের অংশ আর উঠোন, চারুলতার অন্দরমহল এ সবের পেছনে ছিল তাঁরই হাতের ছোঁয়া। ইউনিটের মধ্যে তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি ‘মানিক’ বলে ডাকতেন সত্যজিৎ রায়কে। পথের পাঁচালীর সময় কাজ করতে করতে সত্যজিৎ তন্ময় হয়ে কাট বলতে ভুলে গেলে বংশীকেই মনে করাতে হত – ‘মানিক, কাট বলো, কাট বলো।’
এমনিতে কাশ্মীরের মানুষ বংশী। জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের‚ আজকের পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। পরিবারের সঙ্গে ছোটোবেলায় চলে আসেন কাশ্মীরে। শুভ ঠাকুরের পরামর্শে এসেছিলেন কলকাতায় - ছবি আঁকার স্বপ্ন নিয়ে। সেই শিল্পীসত্তা সার্থকতা পেল - তবে ক্যানভাসের বদলে সিনেমার সেটে। তাঁর শিল্প নির্দেশনাই তো ছবি আঁকার মত ছন্দোময়। বংশী মগ্ন হয়ে সেট গড়ছেন দেখে ছবির কাজ দশ দিন পিছিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ - শিল্পীকে তাড়া দিয়ে বিরক্ত করেননি, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাই বংশীর হাতে তাঁর ছবির সেটও হয়ে উঠেছে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত – এঁদের মিলিত উদ্যোগে পথ চলা শুরু করল ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। আর ১৯৫২-তে আরম্ভ হল সেলুলয়েডে সত্যজিৎ-বংশী যুগলবন্দি। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ পর্যন্ত টানা দু’দশক একসঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। শিল্প নির্দেশক হিসেবে তিনি অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু ত্রয়ী’ সহ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’‚ সীমাবদ্ধ‚ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’‚ ‘গুপী গায়েন বাঘা বাইন’‚ ‘চিড়িয়াখানা’‚ ‘নায়ক’‚ ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’‚ ‘চারুলতা’‚ ‘মহানগর’, ‘অভিযান’‚ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’‚ ‘তিন কন্যা’‚ ‘জলসাঘর’ ও ‘পরশপাথর’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র ও ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ তথ্যচিত্রে । এর পাশাপাশি করেছেন ভারতের অন্যান্য বিশিষ্ট পরিচালকের ছবির অন্দরসাজও। মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করেছেন ‘আকালের সন্ধানে’‚ ‘আকাশকুসুম’‚ ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মতো ছবিতে । শ্যাম বেনেগালের ‘তরঙ্গ’‚ মুজাফফর আলির ‘উমরাও জান’‚ বাসু চ্যাটার্জির ‘পিয়া কা ঘর’, তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’‚ অপর্ণা সেনের ‘৩৬‚ চৌরঙ্গি লেন’‚ ইসমাইল মার্চেন্টের ‘মহাত্মা অ্যান্ড দ্য ম্যাড বয়’‚ জেমস আইভরির ‘দ্য গুরু’ —এমন অনেক প্রসিদ্ধ চলচ্চিত্রের অন্দরসজ্জা সার্থক হয়েছে তাঁর নান্দনিক বোধে ।
শিল্পী হিসেবে খুঁতহীন কাজ করাই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। যতক্ষণ না পরিচালক সন্তুষ্ট হচ্ছেন‚ কাজ করেই যেতেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত । আবার হয়তো দেখা গেল কাজ পরিচালকের পছন্দ হয়েছে, কিন্তু তাঁর নিজের হয়নি। তখনও নিখুঁত কাজ তুলে ধরার প্রচেষ্টায় নিরলস থাকতেন তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবির ক্ষেত্রে ঘটেছিল দুরকম ঘটনাই। উঁচুতে উঠে সিলিঙের একটা মোটিফ সাজাতে বংশী সময় নিচ্ছেন অনেকক্ষণ। সত্যজিৎ একবার মজা করে বললেন, ‘একটু ফাঁকি দিতে শেখ’। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আবার অন্য একটি দৃশ্যে অভিনেতারা মেকআপ নিয়ে প্রস্তুত। সেট‚ আলো সব তৈরি। কিন্তু পরিচালকের মনে হল সেজবাতির কালচে ভাব আরও গাঢ় করতে হবে। বংশী আবার আধঘণ্টা ধরে বাতি ঠিক করলেন। ততক্ষণ মেক আপ নিয়ে পরম ধৈর্যে অপেক্ষা করলেন শাবানা আজমি‚ সঞ্জীব কুমার‚ আমজাদ খানের মতো শিল্পীরা। কাজ নিখুঁত হল; পরিচালক‚ শিল্প নির্দেশক দুজনেই সন্তুষ্ট – তারপর শুরু হল শুটিং।
জীবনে তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন বংশী - ১৯৭২ সালে সীমা‚ ১৯৭৬-এ দো ঝুট এবং ১৯৮২ সালে চক্র ছবির জন্য। মরণোত্তর ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান ১৯৮৩-তে। এত ছবির অন্দরসজ্জা করেছেন যিনি, তাঁর জীবনের শেষ হয়েছিল বিধাতার গড়া এক অপ্রত্যাশিত সেটে। ১৯৮১-র ২৭ জুন। নিউ ইয়র্কের এক স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য ছুটতে ছুটতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই সব শেষ। খবর পেয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন সত্যজিৎ।
এরপর যে মানুষটির কথা বলতেই হয়, ফটোগ্রাফার হবার কথাই ছিল না তাঁর। কিন্তু একটা কুড়িয়ে পাওয়া ক্যামেরা বদলে দিল তাঁর জীবন, আর তিনি হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ রায়ের এক এবং অদ্বিতীয় স্থিরচিত্রী - নিমাই ঘোষ। প্রথমে শখ ছিল অভিনেতা হবেন। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয়ও করেছিলেন 'জুলিয়াস সিজার', 'ওথেলো', ‘বিচারের বাণী’, ‘নিচের মহল’ প্রভৃতি নাটকে। ১৯৬৮ সালে বদলে গেল সবকিছু। খবর পেলেন 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবির শুটিং চলছে রামপুরহাটে। শুটিং দেখতে গেলেন। অভিনেতাদের নির্দেশ দিচ্ছেন সত্যজিৎ। হাতের কাছে তাঁকে পেয়ে নিমাই ঘোষ কয়েকটি ছবি তুলে ফেললেন পর পর। দেখে প্রশংসা করলেন স্বয়ং সত্যজিৎ - ‘আপনি তো আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছেন!’ সেই থেকে যাত্রা শুরু, এরপর সঙ্গী ছিলেন সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত। একবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয়ও করেছিলেন – ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে। দু দশকেরও বেশি সময় ধরে বছর ধরে অ্যানালগ ক্যামেরায় নানা অ্যাঙ্গেলে বন্দি করেছেন সত্যজিৎ রায় এবং তাঁর সৃষ্টিকে। রঙিন ছবিও তুলেছেন, তবে সাদা-কালো ছবি তুলতেই পছন্দ করতেন বেশি। ছবি তুলতে কখনও ব্যবহার করেননি ফ্ল্যাশ বা অতিরিক্ত আলোকসজ্জা। ছবি তোলার উৎস হিসেবে তাঁর কাছে প্রকৃতির আলোই ছিল শেষ কথা।
আজ আমরা সত্যজিৎ রায়ের ছবির যে স্থিরচিত্র দেখতে পাই তা নিমাই ঘোষের ক্যামেরার ম্যাজিকেই। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষ, এম এস সথ্যু, তপন সিংহের সঙ্গেও পরবর্তীকালে কাজ করেছিলেন। তাঁর লেখা ও ছবিতে সমৃদ্ধ ‘মানিকদা : মেমোয়ারস অব সত্যজিৎ রায়’, ‘ড্রামাটিক মোমেন্টস : ফটোগ্রাফস অ্যাণ্ড মেমরিজ অব ক্যালকাটা থিয়েটার, ফ্রম দ্য সিক্সটিজ টু দ্য নাইনটিজ ’-এর মত বই আজ অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। ২০১০ সালে ‘পদ্মশ্রী’র মতো সম্মান পেয়েছেন, দেশে বিদেশে বহু প্রদর্শনীও হয়েছে তাঁর তোলা ছবির। কিন্তু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া বলতে ‘মানিকদা’র সান্নিধ্য – জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই স্মৃতিই তাঁর সর্বস্ব ছিল।
সুব্রত মিত্রকে স্কুল কলেজবেলা থেকেই ধরেছিল বিদেশি ছবি দেখার নেশা। জঁ রেনোয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির শুটিং করতে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর চিত্রগ্রাহক ক্লদ রেনোয়ার সঙ্গে পরিচয় হল সুব্রতর, পেলেন স্থানীয় পর্যবেক্ষকের কাজ। তার পর্যবেক্ষণের খুঁটিনাটি মুগ্ধ করেছিল জঁ রেনোয়াকেও। সেই সময় রেনোয়ার সেটের কাজ করছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আর সপ্তাহান্তে শুটিং দেখতে আসতেন তরুণ সত্যজিৎ। সেই আলাপের সূত্র ধরে এই ত্রয়ীর একসাথে চলা শুরু ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে। এই ‘পথের পাঁচালী’ থেকেই আমরা দেখতে পেলাম ইম্প্রেশনিস্ট আলোর ব্যবহার। কচুপাতার উপর ভোরের নরম আলো কী আমেজ তৈরি করে, তা এর আগে দেখেননি ভারতের দর্শক।
অপরাজিত ছবিতে হরিহরের উঠোন সেটে বানালেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আর বারাণসীর প্রায়-অন্ধকার গলির মধ্যেকার বাড়ির ভেতরে আলোর বাস্তবতা ফোটাতে সাদা কাপড়ের উপর আলো প্রতিফলিত করে ফেললেন সুব্রত। উদ্ভাবন হল বাঙ্ক লাইটের। আবার চারুলতার জন্য দরকার হল অন্য ধরনের আলোর কাজ। সেটের মাত্রা ও ঘনত্ব বাড়াতে কাঠের বাক্সের সাহায্যে বক্স লাইটের খেলা দেখালেন সুব্রত। কাঞ্চনজঙ্ঘায় কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ের রূপ ফুটিয়ে তুললেন মায়াবী ক্যামেরার কাজে। ১৯৮৫ সালে পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের জাতীয় পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পান কোডাক পুরস্কার।
চোখের সমস্যার কারণে খুব বেশিদিন ক্যামেরার কাজ করতে পারেননি। তারপর থেকে সত্যজিতের ক্যামেরাম্যান হিসেবে আমরা পাই সৌমেন্দু রায়কে। পূর্বসূরি সুব্রতর অনুসরণেই যে তাঁর পথ চলা, সেকথা বারবার বলেছেন সৌমেন্দু। সুব্রতর আর একটি গুণের কথাও বলতে হয় – সেতার বাজাতেন ভালো। ‘পথের পাঁচালী’র চিনিবাস ময়রার বাঁক নিয়ে যাবার দৃশ্যের আবহ রচনা করে যেতে পারেননি পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ওই অংশটির জন্য সেতার বাজিয়ে দেন সুব্রত মিত্রই।
‘পথের পাঁচালী’র গৌরবে নাম-যশ-খ্যাতি পেয়েছিলেন এ-ছবির সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলেই, শুধু আড়ালে থেকে গিয়েছিলেন এডিটর দুলাল দত্ত। অথচ ছবি শেষ করার সময় একটানা কাজ করে অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন তিনি, সত্যজিৎ নিজে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করে গেছেন সে কথা। কম কথার মানুষটি ব্যস্ত থাকতেন নিজের কাজ নিয়েই। বংশী চন্দ্রগুপ্তই তাঁর আলাপ করিয়ে দেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। ততদিনে দু চারটি ছবির কাজ করে ফেলেছেন তিনি। সেদিক থেকে পরিচালক, চিত্রগ্রাহক –এঁদের তুলনায় হাতেকলমে কাজের অভিজ্ঞতা তাঁর বেশিই ছিল। ‘পথের পাঁচালী’ সম্পাদনার জন্য নামমাত্র পারিশ্রমিক পাবেন জেনেও কাজ করতে রাজি হলেন তিনি।
রেলগাড়ি দেখতে অপু দুর্গার সেই কাশবনের মাঝখান দিয়ে ছোটার দৃশ্যের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কম শট নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। অর্থাৎ দৃশ্যটি পর্দায় যতক্ষণের, সেই অনুপাতে শটের সংখ্যা কম। উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন দুলাল। ওই শটগুলোকেই এমন ভাবে এডিট করলেন তিনি, তাতেই তৈরি হল গতিচিত্রের এক নতুন ভাষা। গতি ও বিরতির সমন্বয়ে তাঁর এডিটিং-এ ধরা দিত ছন্দ; কাট পয়েন্ট আর জাম্প কাট এর ব্যবহারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে ‘মেমরি গেম’ এর দৃশ্যে, অথবা ‘নায়ক’-এ যখন অরিন্দমের ইন্টারভিউ থেকে কাট করে, লং শটের পর ট্রেনের প্যান্ট্রি থেকে দেখা যায় অরিন্দম সুটকেসটা টানতে টানতে ঢুকছেন, সেই জায়গায় এডিটিং-এর কাজ তো বিশ্বমানের।
অন্য কয়েকজন পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ হননি কারও সঙ্গে। ‘মানিকবাবু’কে ছেড়ে যাবেন না বলে একসময় ‘মার্চেন্ট আইভরি’ প্রোডাকশনের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করার লোভনীয় সুযোগ ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। শেষ জীবনটা কেটেছিল অবহেলায়, আর্থিক অনটনের মধ্যে। তবু সারা জীবন লাভের কথা না ভেবে হৃদয় দিয়ে কাজ করে গেছেন প্রচারবিমুখ এই কারিগর।
সত্যজিৎ রায় নিঃসন্দেহে সম্রাট। তাঁর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন আর স্মৃতিচারণে, তাঁর সৃষ্টিসমীক্ষায় মুখর হয়ে উঠবে সবাই। এটাই স্বাভাবিক, আর অভিপ্রেত তো অবশ্যই। তাঁর অভিনেতা- অভিনেত্রীদের কাজেরও মূল্যায়ন হবে নিশ্চয় নতুন করে। কিন্তু সেই সম্রাটের জয়যাত্রায় নেপথ্য থেকে নিরলস ভূমিকা নিয়েছিলেন যেসব মন্ত্রী – যাঁরা পূর্ণতা দিয়েছিলেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিকে, তাঁদের কথা কি আড়ালেই থেকে যাবে?