ছেলের দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন মা। চুপচাপ বসে আছে সে। মনের অবস্থাটা মা হয়ে খানিক টের পাচ্ছেন তিনিও। খুব শখ করে একটি সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল ছেলে। গ্রামের ছবি, ভাই-বোনের সম্পর্ক— সব মিলিয়ে বাংলার এক রূপ দেখাতে চেয়েছিল সে। মা প্রথমে এমন পরিকল্পনায় রাজি হননি। কিন্তু বিশ্বাস ছিল নিজের সন্তানের ওপর। কিন্তু বিধি বাম! মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল সিনেমা। টাকা নেই আর। ছেলের এমন ভেঙে পড়া চেহারা কি মা হয়ে দেখতে পারেন সুপ্রভা রায়? ছুটে গেলেন নিজের ছোটোবেলার বন্ধু বেলা সেনের কাছে। রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন বেলার আত্মীয়। সুপ্রভার কথা রাখলেন তিনি। আর তারপর? তৈরি হল ‘পথের পাঁচালী’ নামক এক রূপকথার…
জীবনী লিখতে গিয়ে বা ইতিহাসের পাতা ওলটালে সুপ্রভা রায়ের নামটিই কেবল ভেসে ওঠে। সুকুমার রায়ের সহধর্মিণী, এবং সত্যজিৎ রায়ের মা— এই ছিল তাঁর পরিচয়। কিন্তু সুপ্রভা রায় কি কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ? বিয়ের পর এমন একটি পরিবারের সদস্য হয়ে এসেছিলেন, যারা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁর স্বামী একজন ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি। কিন্তু সেসবের বাইরেও নিজের এক অস্তিত্ব তৈরি করেছিলেন সুপ্রভা দেবী। নিজে ছিলেন ব্রাহ্ম; সেইসঙ্গে ছিলেন মুক্তমনা। সারাজীবন সংসারের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকবেন, এমন অভিপ্রায়ও তাঁর কখনও ছিল না। অন্তত তাঁর জীবন দেখলে কখনই সেই কথা বলা যাবে না…
১৮৯২ সাল। জমিদার কালীচরণ গুপ্ত’র ঘরে জন্ম নিল এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। নাতনিকে দেখে বড়োই আপ্লুত জমিদারমশাই। সেখানেই বেড়ে উঠছিলেন সুপ্রভা। ব্রাহ্ম পরিবেশ পেয়েছিলেন ছোটো থেকেই। ঢাকার ইডেন গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর সুপ্রভা চলে এলেন কলকাতায়। তখন শহরে আছেন তাঁর মাসি। তাঁর স্বামী, অর্থাৎ সুপ্রভার মেসোমশাই প্রাণকৃষ্ণ আচার্য ছিলেন সেই সময়ের অত্যন্ত নামী ডাক্তার। তাঁদের বাড়িতে থেকেই সুপ্রভার পরবর্তী পড়াশোনা শুরু হয়। বেথুন কলেজের আঙিনায় পা রাখলেন তিনি। কলাবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। এমন সময় তাঁর জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেল আরেক বিশেষ পরিবারের নাম— রায়চৌধুরী পরিবার। উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়ের সঙ্গে বিবাহের সম্পর্ক স্থাপন হল। ইতিহাসের পথ চলাও শুরু হয় সেই দিনটি থেকে; ১৯১৩ সাল, ১৩ ডিসেম্বর…
দিব্যি চলছিল সব। ১৯১৩ থেকে ১৯২৩— দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু আচমকাই যেন সেই রাস্তা থেমে গেল। ১৯২৩ সালে অকালে চলে গেলেন সুকুমার রায়। বাংলা সাহিত্য, শিল্পকে কেবল একা করে দিয়ে গেলেন না; দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ল ইউ রায় অ্যান্ড সনসও। উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরে যে প্রেস এক বিপ্লব এনেছিল বাংলার বুকে। অদ্ভুতভাবে, সুকুমার রায়ের প্রয়াণের তিন বছরের মধ্যেই অকূল পাথারে পড়ে এই সংস্থা। একরত্তি ছেলে সত্যজিৎকে নিয়ে তখন একা সুপ্রভা রায়। কী করবেন? কোথায় যাবেন তিনি?
উপায়ান্তর না দেখে সুপ্রভা চলে এলেন দক্ষিণ কলকাতায়, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে। তখনও তিনি যুবতী। সেইসঙ্গে রয়েছে মুক্তচিন্তা। তিনি তো এখনও সবল; তাহলে কেন সমস্ত ব্যাপারে ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? কেন সবসময় মেয়েরাই অসহায় হয়ে থাকে এই সমাজে? এখান থেকে শুরু হল সুপ্রভা রায়ের নিজস্ব গল্প। প্রতিদিন দক্ষিণ কলকাতা থেকে বাসে করে উত্তর কলকাতায় চলে আসতেন তিনি। তখনকার দিনে এই কাজটি কোনো বিপ্লবের থেকে কম ছিল না। বিদ্যাসাগর বাণী ভবনের হস্তশিল্প বিভাগের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এই পুরো ব্যাপারটির পরিচালনায় থাকতেন লেডি অবলা বসু। বাংলার নারী জাগরণের আরেক প্রতীক। নিজের অজ্ঞাতে সুপ্রভা দেবীও কখন সেই পতাকাটা হাতে তুলে নিলেন, বুঝতে পারলেন না। ঠিক করেছিলেন, নিজের স্নেহের ‘মানিক’কে ভালোভাবে গড়ে তুলবেন তিনি। শিক্ষা, সংস্কৃতি সমস্ত দিক থেকে।
বস্তুত বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের বিরাট জগতের সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয়ই হয়েছিল তাঁর মায়ের দৌলতে। ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি বিষয়গুলি তাঁকে মা সুপ্রভা রায়ই দেখিয়ে দিতেন ছোটবেলায়। গতানুগতিক ভাবে নয়, মানিককে ছেড়ে দিতেন নিজের মতো। হাতে তুলে দিতেন দেশবিদেশের সাহিত্য। আর এসবের পাশাপাশি চলত সুপ্রভার নিজের কাজ। কখনও সেলাই করছেন, চামড়ার ব্যাগ তৈরি করছেন; আবার শিল্পী নিতাই পালের কাছ থেকে মাটির জিনিসপত্র তৈরিও শিখছেন। নিজে খুব ভালো গানও গাইতেন সুপ্রভা রায়। হিন্দুস্থান রেকর্ডিংয়ে রেকর্ডও করেছিলেন তিনি। যখনই পারতেন, নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন। যেটুকু আয় হত, তাতেই চলত মা-ছেলের সংসার।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
তবে এসব করতে গিয়ে ছেলে সত্যজিৎকে এতটুকুও চাপ দেননি তিনি। চাকরি করতেই হবে- এমন দায়িত্বও কখনও চাপিয়ে দিতে চাননি ছেলের ওপর। ও নিজের মতো বাড়ুক, নিজের রাস্তা খুঁজে নিক; টাকা রোজগারের জাঁতাকলে যদি না পড়তে চায়, না পড়ুক— এমনটাই চাইতেন সুপ্রভা রায়। নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সত্যজিৎকে পাঠিয়ে দিলেন শান্তিনিকেতনে। এসবের মধ্যে সত্যজিৎ আরও বিকশিত হয়ে উঠলেন। পরবর্তীকালে যখন নিজেরই আত্মীয় বিজয়া-কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনও বাধা দেননি সুপ্রভা। পরবর্তীকালে সেই ছেলেই বাংলাকে আরও উজ্জ্বল করছেন, এমনটা দেখে গিয়েছিলেন সুপ্রভা। অন্তত শুরুটা তো দেখেছিলেনই। আর পাঁচটা বাঙালি পরিবার থেকে যেন সবদিক থেকেই আলাদা ছিলেন তিনি। মনে প্রাণে ছিলেন স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত এবং আধুনিক। আর সেই ছায়াই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সব জায়গায়।
Powered by Froala Editor