গান্ধীজির মৃত্যুতে গান থুড়ি নতুন রাগ বাঁধলেন রবিশঙ্কর

'স গ ম ধ ন স, সন ধম, গন ধ, মগবগমগমস'- এমনই ছিল সেই রাগের চলন। নতুন রাগ বাঁধলেন রবিশঙ্কর। ১৯৪৮ সাল। ভারতীয় রাজনীতি বাস্তবিকই তখন দুর্যোগের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে যেন কিছুতেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। গান্ধীজিকে হত্যার দুঃসংবাদ মাত্র দুদিন পেরিয়েছে। গোটা দেশ শোকাচ্ছন্ন। বোম্বেতে গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রেডিওতে একটি অনুষ্ঠান করার কথা রবিশঙ্করের। অনুষ্ঠানের বাজনাটি হবে মূলত আলাপ-নির্ভর। এক অতিনিকট আত্মীয়ের শোক যেন ছায়া ফেলে যায় সেই সুরে। কী বাজাবেন ভাবতে ভাবতে একটি নতুন রাগের আদল মাথায় চলে আসে রবিশঙ্করের। শোকের মূর্ছনা নির্মাণে পঞ্চমকে বাদ দেন তিনি। শুদ্ধ রেখাবের বিশেষ ও স্বল্প প্রয়োগ এই রাগে, আর ধৈবত নিষাদের কোমল উপস্থিতি। গান্ধী - নামটাই যেন জন্ম দিয়ে যায় একটি ভিন্নস্বাদের রাগ। তাই সেই রাগে বারবার ঘুরে আসে গ-নি-ধ। আর তারপর মোহনদাসকে উৎসর্গ করে রাগের নাম রাখেন- মোহনকোষ।

রবিশঙ্করের এই রাগ এখন আর কেউ বাজান কিনা জানা নেই। কিন্তু রাগটির ভিতর দিয়ে মানুষটাকে আরো একবার অমর করে রাখলেন রবিশঙ্কর৷ তাতে রয়ে গেল তাঁর নিজস্ব সিগনেচারটিও। ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে প্রথাগতভাবে শিখতে শুরু করেছিলেন কৈশোর পেরিয়ে। হয়তো এ-কারণেই প্রথার নিগড়ে বাঁধা পড়তে পারেননি তিনি। প্রথা শিখেছেন যেমন, তা ভেঙেওছেন ভারি নিপুণ কৌশলে। আর এর ফলেই ভারতীয় রাগসঙ্গীতে অসংখ্য বর্ণ ও বৈচিত্র্যতর জন্ম হয়েছিল তাঁর হাতে। সেসব বৈচিত্র্য তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিদেশের আঙিনায়। 'ওয়ার্ল্ড মিউজিক' বলতে আমরা যা বুঝি, তার এক নতুন ধাঁচা বেজে উঠেছিল রবিশঙ্করের সেতারে। সেতারের চিরাচরিত আদলটিকেও বদলে নিয়েছিলেন রবিশঙ্কর, তাঁর সুরের ও গায়কীর ধরণ-অনুসারে। রাগসঙ্গীত যখন ক্রমশ আটকে পড়ছে সীমিত কিছু সমঝদার শ্রোতার মধ্যে, তখন কিন্তু তাকে সেই নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে মুক্তি দিচ্ছেন তিনি। রাগসঙ্গীতের নতুন শ্রোতা তৈরি হচ্ছে। বিস্তীর্ণ পরিমাণ লোকের কাছে পৌঁছতে গিয়ে কোথাও লঘু করছেন না তিনি সুরের গাম্ভীর্য বা তন্ময়তা। সেগুলি বজায় রেখেই নতুন এক আদল। তাঁর সুর তাই এত বর্ণময়, বৈচিত্র্যময়।

এই বর্ণিল সুরকারকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানাবেন ঠিক করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। 'অপরাজিত'র আগেই তা করার কথা। রবিশঙ্করের অনেকগুলি স্কেচও বানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। স্কেচগুলি রয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তা প্রকাশ করে হার্পার কলিন্স প্রকাশনা সংস্থা। তথ্যচিত্রটি তৈরি হলে হয়তো আরো গভীরে জানা যেত মানুষটি সম্পর্কে।

Powered by Froala Editor