চলচ্চিত্রের পর্দায় রূঢ় বাস্তব, জাতীয় পুরস্কার রত্নাবলী রায় প্রযোজিত ‘থ্রি সিস্টারস’-এর

“এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁদের দিনে একবেলা খাবার জোটে কোনোমতে। তাঁরাও যদি খবর পান তাঁদের পরিবারের লোক মানসিক হাসপাতালে রয়েছেন, তাঁরা আদর করে তাঁকে আগলে নিয়ে যান বাড়িতে। কারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বিশ্বায়নের একটা বড়ো প্রভাব পড়ায়, সেখানকার ছবিটাও পাল্টে যায়। তাঁরা সবাই নিজেরা নিজেরা ভালো থাকতে চান…”

বলছিলেন মানসিক অধিকারকর্মী ও সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। প্রসঙ্গ ‘থ্রি সিস্টারস’ চলচ্চিত্র। গতকালই প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের জাতীয় পুরস্কারের তালিকা। আর সেখানেই জায়গা করে নিয়েছে রত্নাবলী রায়-প্রযোজিত ‘থ্রি সিস্টারস’ চলচ্চিত্রটি। ৬৮তম জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে ‘থ্রি সিস্টার’-এর মাথায় উঠেছে সেরা বাংলা নন-ফিকশন চলচ্চিত্রের মুকুট।

তবে চলচ্চিত্র বললে ভুল হবে খানিকটা। পরিচালক পুতুল রফি মাহমুদের এই ছবি আদতে একটি তথ্যচিত্র। তাঁর ক্যামেরায় ধরা ঘণ্টা খানেকের দৃশ্যপট পরিচয় করায় এক রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে। যেখানে মানবিকতা নেই। নেই পরিমিত দায়িত্ববোধ। মানসিক রোগ ও মনোরোগীদের প্রতি অবহেলা, পারিবারিক হিংসারও বহিঃপ্রকাশ ফুটে ওঠে এই ছবির ছত্রে ছত্রে। 

শিখা, রূপসী, সীমা— মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী এই তিন বোনের গল্পই ‘থ্রি সিস্টার’। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। কলকাতার একটি সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁদের। তারপর দু’দশক কেটে গেলেও তাঁদের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে যাননি তাঁদের বাড়ির সদস্যরা। খোঁজ-খবর নেননি কেউ। এমনকি মাতৃবিয়োগের সংবাদটুকুও কেউ পৌঁছে দেয়নি হাসপাতাল পর্যন্ত। 

মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী তিন বোনকে হাসপাতাল থেকে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মানসিক অধিকারকর্মী রত্নাবলী রায়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি, সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফের হাসপাতাল— এই গোটা জার্নিটাই ধরা পড়েছে পুতুল মাহমুদের লেন্সে। তবে এই ছবির নির্মাণ চলেছে আরও বছর খানেক আগে থেকে। রত্নাবলীর কথায়, “যাওয়াটা শুধু একদিনের, কিন্তু তার বাইরে ওঁদের প্রস্তুত করা, নিজেদের প্রস্তুত করার বিষয়টাও তো ছিল। ভয় ছিল, কমিউনিটি আমাদের কীভাবে নেবেন। বাড়ির লোক যে ওঁদের গ্রহণ করবেন না, সেটা আমরা মনে মনে জানতাম। কিন্তু তিন বোনের কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম না।”

হ্যাঁ, সিনেমার শুরুতেই নজর কাড়ে এমনই এক দৃশ্য। বাসের সিটে বসে স্বপ্নের জাল বুনতে দেখা যায় তিন বোনকেই। কেউ প্রতীক্ষায় থাকেন মায়ের সঙ্গে দেখা করার, কেউ আবার তাঁর সন্তানের অপেক্ষায়। তবে বাস্তব জগৎ যে তাঁদের তৈরি স্বপ্নরাজ্য থেকে কতটা আলাদা, তা ধরা পরে পরবর্তী ৪৫ মিনিটে। না, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে খুশি হলেও, পুরনো জীবনে ফিরতে চাননি তিন বোনই। বরং, মাথা উঁচু করেই ফিরে আসেন হাসপাতালে। 

বিগত ২৭ বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন রত্নাবলী রায় এবং তাঁর সংস্থা ‘অঞ্জলি’। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণের মধ্যে সচেতনা গড়ে তুলতে চালিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত লড়াই। ‘থ্রি সিস্টারস’ সেই লড়াই-এর আরও একটি মাইলফলক। মানসিক রোগের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। 

রত্নাবলী রায়ের প্রযোজনায় বাস্তব বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ ম্যাডনেস’ ট্রিলজি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরিচালক পুতুল মাহমুদ। সেই ট্রিলজির প্রথম ছবি ‘অতসী’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছিল মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। এবার দ্বিতীয় ছবি ‘থ্রি সিস্টারস’-ও নজির তৈরি করল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে… 

Powered by Froala Editor