অপারেশন হয়ে যাওয়ার দু’সপ্তাহ পরেও সারছিল না চোখ। দৃষ্টি বলতে শুধু একটা আবছা গোলাকার বস্তু। আর তার দু’দিকে দুটো হুক। ক্রমে বাড়ছিল যন্ত্রণা। অথচ চোখের অপারেশনে তো এত ভোগান্তি হওয়ার কথা নয়। তবে কি চিকিৎসাতেই বিভ্রাট হল কিছু? চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও মনোবিদ রত্নাবলী রায় (Ratnaboli Ray)।
গত ৪ নভেম্বর ডাঃ বিকে সরকারের অধীনে অস্ত্রোপচার হয়েছিল রত্নাবলীর চোখে। ফেকো পদ্ধতিতে ছানি অপারেশন। সাধারণত এই পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করা হলে, দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে রোগী। দৃষ্টি ফিরে আসে একদিনের মধ্যেই। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ফেকো কোনো জটিল অপারেশন নয়। বিশেষত আজকের দিনে অতিসাধারণ একটি অস্ত্রোপচার ফেকো। এমনকি বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্লাবের আয়োজিত চক্ষু শিবিরেও ছানি অপারেশন করা হয় এই পদ্ধতিতেই। তবে সময় পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমশ সমস্যা বাড়ছিল রত্নাবলীর। ক্রমশ ফুলে উঠছিল চোখ।
শুধু চোখ নয়, অনেকক্ষেত্রেই অপারেশনের পর সমস্যা দেখা যায় রোগীর দেহে। সে-ক্ষেত্রে পুনরায় পরীক্ষা করে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণই কাম্য। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। পুনরায় পরীক্ষা নয়, কিংবা নতুন করে অপারেশনও নয় বরং রোগীকে ‘পজিটিভ’ থাকার পরামর্শ দেন ডাঃ বিকে সরকার। একবার নয়, একাধিকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও কোনো সমাধান পাননি রত্নাবলী। “আমাকে যে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খেয়ে রীতিমতো বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়ে যায়”, জানালেন রত্নাবলী। জানা গেল, রাতে টানা কয়েকদিন ঘুমাতেও পারেননি তিনি।
পরিস্থিতি ক্রমশ সংকটজনক হয়ে উঠতে দ্বিতীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নেন রত্নাবলী। সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন ঘনিষ্ঠরা। পারিবারিক সুপারিশে দ্বারস্থ হন ‘অমূল্য জ্যোতি আই ফাউন্ডেশন’-এ ডাঃ অরূপ চক্রবর্তীর কাছে। সেখানেই ধরা পড়ে মূল সমস্যা। ‘ডিসলোকেট’ হয়েছে চোখের লেন্স। দীর্ঘ পরীক্ষা, ইউএসিজি এবং মেডিক্যাল চেকআপে থাকার পর সম্প্রতি দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করা হয় রত্নাবলীর চোখে। দায়িত্বে ছিলেন ‘অমূল্য জ্যোতি’-র ভিট্রিয়োরেটিনা সেশালিস্ট ডাঃ বিকাশ বসু। তাঁর কথায়, “ছানি সরিয়ে দিয়ে, তার একটা লেয়ারের ওপর লেন্সটাকে বসানো হয়। সেই সাপোর্ট ব্রিচ হয়ে গিয়েছিল এক্ষেত্রে। ফলে দ্বিতীয়বার অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।”
রত্নাবলীর মুখেও শোনা গেল একই কথা। জানালেন, “হুক ওয়ালা যে জিনিসটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, সেটা আদতে চোখের লেন্স। ভিট্রিয়াস ফ্লুইডের মধ্যে তা ভেসে বেড়াচ্ছিল এই লেন্স। হেমারেজ হয়েছিল চোখের মধ্যে। প্রায় অন্ধ হতে বসেছিলাম। এই ধরনের ঘটনা খুবই রেয়ার ইভেন্ট।” দৃষ্টি হারানোর সম্ভাবনা তো ছিলই, সেইসঙ্গে এই সমস্যার জন্য দীর্ঘদিন ট্রমার শিকার হয়েছেন তিনি— সেটাও স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল তাঁর কথায়। তবে এ-ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ডাঃ বিকে সরকারের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, কথা বলা সম্ভব হয়নি তাঁর সঙ্গে।
রত্নাবলী রায়ের এই ঘটনা থেকেই উঠে আসে একাধিক প্রশ্ন। উঠে আসে চিকিৎসা জগতের এক অন্ধকার দিক। রোগী বার বার সমস্যা জানানোর পরেও কি বাড়তি পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন না চিকিৎসক? অথচ, ইউএসজির মতো প্রযুক্তি কলকাতা তো বটেই, গোটা বাংলার বুকেই সহজলভ্য। তবে সমস্যা শনাক্ত করতে কেন প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছেন না চিকিৎসকরা? নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও দৃষ্টিশক্তি না ফেরার একমাত্র সমাধান কি তবে ‘বি পজিটিভ’-এর মতো ভোকাল টনিক? সমাজকর্মী হওয়ায় হয়তো এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন রত্নাবলী রায়। পেয়েছেন বহু মানুষের সাহায্য, দ্বিতীয় চিকিৎসকের পরামর্শ। কিন্তু যাঁদের সেই সুযোগ, আর্থিক সক্ষমতা নেই, তাঁরা? তাঁদের কি এক্ষেত্রে কেবলই ভরসা করে থাকবেন চিকিৎসকের আশ্বাসবাণীর ওপর?
না, এইসব প্রশ্নের কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই। নেই কোনো সরকারি নিয়মাবলি ও রেগুলেশনও। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হলেও, যেন ফাঁক রয়েই গেছে তাঁর মধ্যে। আর সেই ফাটল থেকেই ক্রমশ প্রশস্ত হচ্ছে রোগীদের ভোগান্তি। কোথাও কোথাও থেকে যাচ্ছে চিকিৎসকদের গাফিলতি, মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণের মতো সমস্যা। “রোগীর এই অধিকার এবং রেগুলেশন তৈরির দাবিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব”, জানালেন রত্নাবলী। তবে লাল ফিতের ফাঁস ছাড়িয়ে তা কবে বাস্তবায়িত হবে তা জানা নেই কারোরই…
Powered by Froala Editor