আষাঢ়ের ঘনমেঘ গাছপালার মাথায় ঝেঁপে এসেছে। প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। জলে জলে গাছপালার শিকড় একেবারে তলিয়ে হারিয়ে গেছে মাটির কোলে।
এইরকম আবহাওয়ায় আজ সকালের দিকে একটু পাখিডাক আর চিকচিক রোদ হলে; মা উঠোন লেপতে লেপতে মনে করিয়ে দিচ্ছে ভুলে যাওয়া কবেকার ছড়া -
'ওই পাড়ার এক ময়নাবু্ড়ো
রথ করেছ তেরোচূড়ো
রথ দেখতে যাবি
আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর
পয়সা কোথায় পাবি?'
আরও পড়ুন
অন্তর্ধানের ১৬০ বছর পর ‘ফিরলেন’ শ্রীচৈতন্য, দীক্ষা দিলেন ঘোষপাড়ার রামশরণকে
এখন ২২ বছরের আয়ু চলছে, এই ছড়াটি শোনা গিয়েছিল ৭ অথবা ৮ বছরের আয়ুতে। মা বলেছিল নাকি বোন বিজয়া?
এটি শোনামাত্র মাথার ভিতর বাতাবিফুলের হলুদাভ পরাগ দপদপ করতে লাগল। অসংখ্য ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে লাগল একসঙ্গে। শূন্যতার ঢেউয়ের ভিতর দেখতে লাগলাম - কাঁসরকে কাঁসর হিসেবে না জেনে, কাঁইনানা নামে জানা তিনজন বালক বসে বসে একমনে খবরের কাগজ কাটছে, একজন উবু হয়ে ময়দার আঠায় পতাকা তৈরি করছে, অন্যজন মাটির জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাকে মাধবীলতার ফুলে ফুলে সাজিয়ে অপরূপকে আরও অপরূপ করছে।
সাজানো শেষ হলে একজন ভাবছে, গল্পে শোনা চৈতন্য এই ঘনকালো, হাত-পা কাটা জগন্নাথের বুকের ভিতরেই মিলিয়ে গিয়েছিলেন? এ-কথা ভাবতেই তার ছোটখাটো নরম দেহকাণ্ডে পরস্তাবের ঢেউ এসে পাগল করে তুলছে। এই ঢেউ থেকে বেরোনোর জন্য, সে কাঁসরকে প্রসাদ রাখার পাত্র করে নকুলদানা রেখে তুলসীপাতা চাপিয়ে দিচ্ছে জলদি জলদি।
এই যে এইখান থেকে রথটানা শুরু হচ্ছে, ঐ যে চলছে ছোটবেলার রথ, খুচরো পয়সা দিচ্ছে মানুষেরা, প্রণাম করছে, একটি নকুলদানা টপ করে মুখে ফেলে মাথায় হাত মুছে নিচ্ছে লোকজন।
ভুট্টা পোড়ানোর গন্ধ, পাঁপড়ভাজা জিলিপি উভয়ের ঘ্রাণ দশদিক চনমনে ও আকুল করে তুলছে। খিচুড়ি পাওয়া যাবে শালপাতার কটোরায় খানিক বাদেই।
কতো জলেডোবা টুকরো কথা মনে ভাসে -
বাবা, কাঁধে নাও।
বোন, হাত চেপে ধর আমার নাহলে হারিয়ে যাব।
ঐ ভেঁপুটা কিনব, কী সুন্দর বেলিফুল, মাটির ঘাড়নড়া বুড়ো কিনে দাও।
মনা, মেলায় এসে এমন করলে পাপ হয় তাতে, চল খিচুড়ি খাই।
গরম তো খিচুড়ি, বাদাম দেওয়া আছে তো? দিদি, তুই খাইয়ে দিবি? তাহলে খাব, বেশ চল মনা ইত্যাদি ইত্যাদি...
আমি ভেবে দেখেছি, কাঁচা হাতে তৈরি কাঁচা মাটির জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা আমাকে রহস্যময়তার জলে ঠেলে দেয়। ভালো করে তাকলে আমি বহু বহু দূর দেখতে পাই, মাটির গায়ে হাতবুলোনো কুমোর বৌয়ের শাঁখাহীন হাতের স্পর্শটুকু বুঝতে পারি যেন। পালপাড়ায় বিধবা-উঠোনের মহানিমগাছের ছায়া এসে লাগে গায়ে।
আমি অনুভব করি, ঠাকুমার পুরী চলে যাওয়া, বালিতে বসে তার উদাসচিন্তা, খলুই ও শঙ্খ কিনে আনা। ন্যাড়ামাথায় এসে লাগা কাছিমের শীতল কালো স্পর্শ।
সাপের বিষ ঝরে পড়া বনের পাশেই আগে রথযাত্রা হত। এখন গঙ্গা সরে গিয়ে এখানে ধানখেত। জগন্নাথকে জল খাইয়ে কসাইয়ের হাত থেকে কাছিম ছা-কে বাঁচিয়ে চলল এক খুনখুনে তিনশো বছর আগেকার বুড়ি।
আকাশ তখন বিশালাক্ষীর চোখের মতো বিশাল।
ঐ প্রাচীন শাদাথান বুড়িই কি আমার ঠাকুমা বুড়ি?
উত্তর মেলে না, দূরবনে কাঠ চেরাইয়ের শব্দ ভেসে আসে, এইসব আশ্চর্য মনে পড়ে প্রতি আষাঢ়ের রথসকালে।
Powered by Froala Editor