বিরল ওয়াটার ফেজেন্ট থেকে কাছিম, হিন্দমোটরের জলায় চলছে নির্বিচার শিকারযজ্ঞ

হিন্দমোটর কারখানা থেকে শুরু করে ডানকুনি মাদার ডেয়ারির বোঁদের বিল। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলজুড়েই রয়েছে কয়েকশো একরের জলাজমি। যদিও নির্মাণ প্রকল্পে ধীরে ধীরে কমে আসছে তার আয়তন। কমে আসছে আয়ু। আর জীববৈচিত্রে ভরা এই জলাজমিতেই চলছে নির্বিচারে পাখি শিকার। রেহাই পাচ্ছে না বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিরাও।

হিন্দমোটরের এই জলাভূমিই ছিল অনেকটা প্রাকৃতিক ফুসফুসের মতো। শীত পড়লেই পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা যেমন লেগেই থাকে এই অঞ্চলে। তাছাড়াও এই অঞ্চলে সারা বছরই দেখা মেলে ডাহুক, শামুকখোল, বক, কালসোল প্রভৃতি পাখির। পাওয়া যায় বাংলার বুক থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ওয়াটার ফেজেন্ট বা জল ময়ূরও। কচ্ছপ, শিয়াল, বাঘরোল প্রভৃতি প্রাণীরও বাসস্থান এই অঞ্চল।

একদিকে এই জলাশয় বুঝিয়েই চলছে শ্রীরাম সিটি প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। অন্যদিকে তাল মিলিয়েই চলছে নির্দ্বিধায় পাখি শিকার। পেতে রাখা হচ্ছে সুতোর ফাঁদ। এই শিকারের পিছনে রয়েছে স্থানীয়দেরই হাত। তবে আঞ্চলিকদের মধ্যে সচেতন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন প্রতিবাদে। কেউ বা পাখি বাঁচাতে হোগলা বনের মধ্যেই পেতে রাখা ফাঁদ কেটে এসেছেন। তবে তার জন্য সমস্যাতেও পড়তে হয়েছে তাঁদের। শিকারিদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে অপদস্থও হতে হয়েছে অনেককেই। কিন্তু এত কিছু পরেও নির্বাক প্রশাসন। 

“এই জলাভূমি গোটা অঞ্চলটার ফুসফুসের মতো। এই জলায় বালিখাল এসে মেশায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি বছর দুয়েক আগে রেটিকুলেটেড পাইথনও উদ্ধার করেছিলেন বনদপ্তরের কর্মীরা। তবে শহর যত এগিয়ে আসছে তত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই জীববৈচিত্র্য। জলাজমি বুজিয়ে ফেলার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এই পাখিশিকারের ফলে ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির”, জানালেন স্থানীয় শিক্ষক শান্তনু ভট্টাচার্য।

সম্প্রতি এক ব্যক্তি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিকারিদের নজর এড়িয়েই তুলে আনেন বেশ কিছু ছবি। তাতে স্পষ্ট দেখা যায় শিকারিদের ফাঁদে জড়িয়েছে দুটি অতিবিরল ওয়াটার ফেজেন্ট বা জল ময়ূর। এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে আসতেই রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকর্মীদের মধ্যে। স্থানীয় পুলিশের কাছেও অভিযোগ দায়ের করেন পশু চিকিৎসক-সহ বেশ কিছু সমাজকর্মী।

আরও পড়ুন
ফিরে দেখা ২০২০ : জীববিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত উল্লেখযোগ্য নতুন প্রজাতি

তবে চোরাশিকারিদের এই বাড়বাড়ন্তের পরেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন অ্যানিমাল অ্যাক্টিভিস্ট তিস্তা দাসও। জানালেন, “বনদপ্তরে যখন ফোন করা হয়েছিল তখন বলা হয় এই অঞ্চলটা ওঁদের আয়ত্তের মধ্যে পড়ে না। এবং স্থানীয় প্রশাসনের মদত না থাকলে এই ঘটনা হওয়া সম্ভব ছিল না। কেউ কেউ বলছেন পাখিগুলোকে ওখান থেকে রিলোকেট করার জন্য। তবে সেটা কোনো সমাধান নয়। রিলোকেট করলে নতুন পরিবেশে গিয়ে পাখিদের একটি মেন্টাল ট্রমা হয়। তাছাড়া এই জলাভূমি থেকেই কচ্ছপ ধরে, সেই মাংস প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। তারপরেও কি তা চোখে পড়ছে না প্রশাসনের?”

তবে শুধুই যে পাখি শিকার কিংবা নির্মাণকার্যে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, তেমনটা নয়। এই অঞ্চলে হিন্দুস্তান মোটরসের কারখানা তৈরির জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাতশো একর জমি। তার মধ্যে মাত্র দুশো একর জমির ওপরে গড়ে উঠেছিল কারখানা। বাকি প্রায় সাড়ে পাঁচশো একর জমি জুড়ে এই জলাভূমি। বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে শীতকাল পড়লেই শুরু হয়ে যায় পিকনিকের তোড়জোড়। থার্মোকলের প্লেট থেকে শুরু করে প্লাস্টিক এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থও শেষে ফেলা হয় এই অঞ্চলেই। সেখান থেকেও ধীরে ধীরে দূষণের কোলে ডুবে যাচ্ছে বোঁদের বিল অঞ্চলটি।

আরও পড়ুন
আটলান্টিকের অতলে ১২টি নতুন প্রজাতির সন্ধান, বছরশেষে উচ্ছ্বসিত বিজ্ঞানীরা

তবে এই অঞ্চল থেকেই কয়েক কিলোমিটার দূরে কালিপুর অঞ্চলে গেলে দেখা যাবে ভিন্ন ছবি। স্থানীয়রাই সেখানে উদ্যোগ নিয়ে মনিটারি লিজার্ড সংরক্ষণের কাজে নেমেছেন। দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২-১৪ ফুট লম্বা এই সরীসৃপদের রক্ষার দায়ভার নিয়েছেন তাঁরা। এই ঘটনারই উল্লেখ করে শান্তনুবাবু জানান, “এভাবেই এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় মানুষকে। নাহলে রক্ষা করা যাবে না পরিবেশের। স্থানীয় মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রশাসন যদি ন্যূনতম ক্যাম্পেনটুকুরও আয়োজন করে, তাহলেও অনেকটা স্বস্তি পায় প্রকৃতি। তাছাড়া পুলিশ প্রশাসনের থেকে অনুমতি পেলে পাখিদের সুরক্ষার কাজে হাত লাগাতে এগিয়ে আসবে অনেক পরিবেশকর্মীই। কিন্তু সেই উদ্যোগটুকুও নেওয়া হচ্ছে না।”

যদিও বৃহস্পতিবারের চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে আসার পর খানিকটা আশ্বাস দিয়েছে স্থানীয় থানা। জানিয়েছে নজর রাখা হবে গোটা অঞ্চলে। কিন্তু তারপরেও কি থামবে পাখি শিকার নাকি চিরতরের জন্যই হারিয়ে যাবে এই সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য? চিন্তার মেঘ কাটছে না পরিবেশকর্মীদের থেকে...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দেশের প্রথম পলিনেটর পার্ক, ৪০টির বেশি প্রজাতি সংরক্ষণের উদ্যোগ

More From Author See More