কোন্নগরে জাতীয় সড়কের ওপর মরে পড়ে আছে একটি প্রাণী। গায়ের রং দেখে, আর কালো ছোপ-ছোপ দাগ দেখে বাঘ বলে মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু বাঘের থেকে অনেক ছোট এই প্রাণীটি আসলে বাঘরোল। গতকাল এবং আজ এই বাঘরোলের ছবি নিয়েই সরগরম হয়ে রইল সোশ্যাল মিডিয়া। পরিবেশকর্মীদের কেউ বলছেন, ছবিটি নাকি 'ফেক', আসলে এমন কোনো মৃত বাঘরোলের হদিশই পাওয়া যায়নি। আবার অনেকে বলছেন, সত্যিই একটি বাঘরোলকে মৃত অবস্থায় দেখা গেছে। ইতিমধ্যে রটে গেছে, গণপ্রহারেই মারা গেছে এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীটি। আর এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসিন্দা থেকে প্রশাসন, প্রত্যেকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ব্যাপকভাবে।
বাঘরোল, বাংলায় যার আরেক নাম মেছো বিড়াল। আইইউসিএন অনুযায়ী বিশ্বের অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় তো বটেই, এই প্রাণীটি বাংলার রাজ্য পশুও। কিন্তু তা যে কেবল নামেই, বেশ কিছু ঘটনা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এমনিতে ভীতু, নিশাচর এই প্রাণীটির আবাসস্থল ছিল মূলত কোন্নগরের জলাভূমি এলাকা। বাংলা ও ওড়িশার অন্যান্য স্থানেও কমবেশি পাওয়া যেত। কিন্তু একটা সময় এর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে আসতে থাকে। কারণ, জলাভূমি বুজিয়ে কারখানা, কমপ্লেক্স, হাইরাইজ তৈরি হওয়া। বিশেষ করে এই হিন্দমোটর-কোন্নগর অঞ্চলের জলাভূমি অংশটি স্বাধীনতার পরই চলে যায় শিল্পপতিদের হাতে। পরে তাঁদের হাত থেকে এই শতাব্দীর শুরুতে চলে যায় রিয়েল এস্টেট গ্রুপের কাছে। ফলে জলাভূমি বুজিয়ে ‘উন্নয়ন’ চলতে থাকে। তাতে সাহায্য করে সরকারও।
কিন্তু এর ফলে সেখানকার পশু পাখিদের জীবন সংশয় হচ্ছে, সেই কথাটি কারোরই মনে করার সময় হয়নি। ফলস্বরূপ, বাঘরোলের সংখ্যাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একে বসবাসের জায়গাও নেই, তার ওপর খাবারও কমে আসছে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই লোকালয়ে ঢুকে পড়া এদের। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।
বাঘরোলের গায়ের রংয়ের জন্য বাঘ বলে ভুল করে ফেলেন অনেকে। এক্ষেত্রেও ঠিক সেই জিনিসটিই ঘটেছে। তার ওপর বিগত বেশ কিছুদিন ধরে ‘বাঘের আতঙ্কের’ খবর ছড়াতে থাকে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। প্রমাণস্বরূপ দেখানো হয় সিসিটিভি ফুটেজও। কিন্তু রাতের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া প্রাণীটি যে আসলে বাঘরোল, সেটা আর বলা হয়নি। ফলস্বরূপ, সন্দেহ করা হচ্ছিল, বিলুপ্তপ্রায় রাজ্য পশুকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এবং, তাদেরই একটির দেহ নাকি পড়ে থাকতে দেখা গেছে কোন্নগরে, জাতীয় সড়কের ওপর।
সত্যিই মারা হয়েছে, না নেহাত গুজব - তা অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদি মারা নাও যায়, তবু সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা স্বস্তির নয়। নিজেরা ‘উন্নয়ন’ করব বলে, আমাদের চারপাশটাকে ‘আধুনিক’ করব বলে পরিবেশের যথেচ্ছাচার করছি। সেই অধিকার কে দিয়েছে? সমস্ত প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম, এবং সর্বোপরি জনসাধারণ নিজেদের দায় অস্বীকার করতে পারবে না। বর্তমান হত্যার খবর যদি ভুলও হয়, তবু এ-কথা মোটেই অস্বীকার করা যায় না যে, বাঘরোলের মতো প্রাণীরা পৃথিবী থেকে মুছে যাচ্ছে মানুষের বিভিন্ন হঠকারিতার জন্যই। রাজ্য প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও, তাকে রক্ষা করার সামান্য দায়িত্বটুকুও নিতে পারছে না কেউ। এই পরিস্থিতি কি লজ্জার নয়?