স্কুটি খারাপ হয়ে পড়ায়, বিপদে পড়েছিলেন ডাক্তার। অন্ধকার চিরে চার জোড়া কামুক হাত হঠাৎ ঘিরে ধরে তাঁকে। তারপর, একটা পোড়া মাংসপিণ্ডের ছবি ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। মগজে বারবার ধাক্কা দিতে থাকল ডাক্তার প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির লাশ। আসিফা বানো, উন্নাওএর সেই মেয়েটির পর, এবার ধর্ষকামের বলি প্রিয়াঙ্কা। স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তিত দেশবাসী। শিউরে উঠছেন অনেকেই। দেওয়াল ভরিয়ে ফেলেছেন নেটিজেন-সিটিজেনদের একাংশ। হয়তো জ্যোতি সিং(নির্ভয়া)-এর পরে এমন নৃশংস যৌনহিংসার নিদর্শন দেখল ভারত। ধর্ষণ তো বর্তমান সমাজে এখনও 'স্বাভাবিকতা'। তবু লজ্জা-ঘৃণা-রাগের পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়...
ঘটনায় অভিযুক্তদের নাম মুহাম্মদ আরিফ, জলু শিবা, জলু নবীন, এবং চিন্তাকুন্তা চেন্নাকেশাভুলু। কিন্ত বারবার সংবাদ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে বড় বেশি প্রচারিত প্রথম নামটি। ফলে উপচে পড়ছে ধর্মীয় ভাবাবেগ। কিন্ত ওই দিনই তো কালীঘাট মন্দিরের সামনেই দুই কিশোরীর উপর যৌন-নির্যাতন চালিয়েছে একদল। তাদের ধর্ম-পরিচয় তো তলিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জালের অন্তরালে। ধর্ষকের ধর্ম-জাত হয় কি? নির্ভয়ার আততায়ীদের মতই এখানেও অভিযুক্তরা নিম্নবর্গ থেকে আসা মানুষ। রাগের পারদ চড়তে চড়তে ধর্ষণ ব্যাপারটিকে আসলে অর্থনৈতিক বর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে ফেলছি কিনা, ভেবে দেখা যেতে পারে। ক্ষমতার আস্ফালন এবং ধর্ষকামী মনোবৃত্তি জাতি-ধর্ম-বর্গ নির্বিশেষে বিদ্যমান। পরিসংখ্যান বলে, বেশির ভাগ ঘটনায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি, অভিযোগকারিণীর পরিচিত। কচি বয়স থেকে আত্মীয়স্বজনের দ্বারা যৌনহেনস্থার শিকার হয়েছেন, এমন নারীর সংখ্যাটা খুব কম না। সর্ষের মধ্যেই ভূত!
এবার আসে রাষ্ট্র পরিচালিত বিচার ব্যবস্থার কথা। অপরাধবিজ্ঞানের বিচারে যেকোনো শাস্তিকে সাধারণত দুটিভাবে দেখা যায়। এক, অপরাধীর সংশোধন এবং পুনর্বাসন। দুই, অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি 'প্রতিহিংসা'। প্রতিহিংসার দিকটি সাধারণত সামাজিকভাবেই নির্মিত। ধর্ষকের ফাঁসির দাবি ওঠে আমজনতার বিক্ষোভে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বয়স। নির্ভয়ার ঘটনার আগে সাধারণত অভিযুক্তদের বয়স আঠারোর নীচে হলে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত না। কিন্ত সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির নিরিখে, আইনের অবস্থান পাল্টেছে। চরম শাস্তির বিরুদ্ধে বাধা হয়ে আর দাঁড়াচ্ছে না বয়স। এরপরেও কি ধর্ষণ কমেছে দেশে? উত্তর, না। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিকৃত কামনা থেকেই ধর্ষণ – এই সহজ অঙ্ক মিলবে না। ধর্ষণের পিছনে অন্যতম কারণ হল পুরুষালি ক্ষমতার আস্ফালন। একটা শরীরকে ছিন্নভিন্ন করার প্রবণতা। সেই প্রবণতা ক্ষমতার, শুধু যৌনতার নয়। কয়েকদিন আগে কিছু মানুষ দাবি করেছিলেন, ভারতের রাস্তাঘাটে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, কিংবা বাড়িতে-বাড়িতে শৌচালয় না থাকা ধর্ষণ হওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা অন্ধকারেই ধর্ষকরা শিকারীর মতো ওঁৎ পেতে থাকে, শৌচালয় না থাকায় বাড়ির মহিলাদের যেতে হয় দূরে, কখনও মাঠেঘাটে। আর সেখানেই শিকারীরা অপেক্ষা করে থাকে। ধর্ষণ যেন সেই আদিম শিকারের জায়গায় পৌঁছে গেছে। মুশকিল হল, ঠিক কত শৌচালয় ধর্ষণের হাত থেকে সমাজের মেয়েদের মুক্ত করতে পারবে, জানা নেই। কারণ, ঘরের নিচেও দিব্যি ধর্ষণ হয়। দাম্পত্যের যে নিশ্চিন্ত বিছানা, সেখানেও হতেই থাকে এমন ঘটনা। এমনকি, যে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের কাছা সাহায্য চাই আমরা, তাদেরও ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে অতীতে, পুলিশ, এমনকি মিলিটারিদেরও। শেষাবধি তাঁরাও সমাজের ভিতরে থাকা মানুষ।
ধর্ষণ একটি সামাজিক অসুখ। ধর্ষকদের শাস্তি চাইতে গেলে গোটা সমাজের শাস্তি চাইতে হয়। ইতিহাস বলছে, শাস্তির ভয়ে কোনো অপরাধেরই ক্ষয় হয় না, কারণ অপরাধ সমাজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। আসুন, আমরা নিজের ভিতরে থাকা সেই অসুখটাকে প্রশ্ন করি।
ঘটনাপ্রবাহে ক্লান্ত অনেকে। বারংবার এটাই প্রমাণিত যে, এদেশে সুরক্ষিত নয় মেয়েরা। ট্রেনে-বাসে-ট্রামে-অফিস কাছারি-বাড়িতেও প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত চাপা পড়ে যায় আর্তনাদগুলি। কামুক চোখ এড়িয়ে পোশাকের ভাঁজ 'ঠিক' করতে তো শেখায় সমাজই। রাত্রি ন'টার পর মেয়েদের বাড়ি ফেরা আজও 'স্বাভাবিক' নয়।
সম্প্রতি মুম্বই-এর একটি সংস্থা আটটি শহরের ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা যাবে,
ক) ৪৩% যুবক মনে করেন, সংসার বাঁচানোর জন্য মেয়েদের মারধোর চুপচাপ মেনে নেওয়া উচিত।
খ) ৪৯ % যুবক এবং ২৩ % যুবতী মনে করেন, ঘরের কাজ সামলে রোজগার করতে পারবে না মেয়েরা।
গ) ৯৮.৫ % যুবক মনে করেন, ঘরের রান্না, বাসন মাজা এবং জামাকাপড় ধোওয়ার দায়িত্ব ছেলেদের না, শুধু মেয়েদের। ছেলেদের গৃহস্থালীর দায়িত্ব বলতে শুধু বিল জমা দেওয়া এবং বাল্ব বদলানো।
সুতরাং, তথ্যাংশ থেকে এটুকু পরিষ্কার, পিতৃতন্ত্রের ছবিটা আজও অমলিন। কিন্ত এই আদ্যন্ত পচাগলা সমাজটা ফেলে দূরে পালিয়ে যাওয়ার উপায় কই? বিকল্প সমাজব্যবস্থাটিও কোথায়?
উত্তর আসবে না। নিকষ অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রাও দীর্ঘমেয়াদি, দীর্ঘস্থায়ী। এই আশাটুকু সম্বল।
তথ্যঋণ : শমীক সরকার