পাড়ায় জলাভাব, মায়ের কষ্ট মেটাতে নিজেই কুয়ো খুঁড়ল রানিগঞ্জের ছাত্রী

শহর এবং মফস্বল থেকে একটু দূরে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে গেলেই যা প্রথম অনুভূত হয়, তা হল জলের অভাব। কোথাও টিউব ওয়েল থাকলেও, তার জল দূষিত হওয়ায় ব্যবহারের অযোগ্য। আবার কোথাও কোথাও টাইম কলের ব্যবস্থা থাকলেও, পর্যাপ্ত জল পান না সবাই। ফলে বহুদূর থেকে জল নিয়ে আসতে হয় গ্রামবাসীদের। বাবা-মায়ের এই ‘কষ্ট’ দূর করতেই অভিনব উদ্যোগ নিল বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জ এলাকার কলেজ পড়ুয়া ববিতা সোরেন। ‘মাউন্টেন ম্যান’ দশরথ মাঝি যেমন একাহাতেই রাস্তা তৈরি করে ফেলেছিলেন পাহাড় কেটে, তেমনই জলাভাব মেটাতে গাইতি শাবল নিয়ে কুয়ো খুঁড়লেন এই কলেজ-ছাত্রী।

বিএড কলেজের অন্তিম বর্ষের মেধাবী ছাত্রী ববিতা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর স্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বসবাস রানিগঞ্জের বক্তারনগরের রেলগেটের কাছে। ববিতা জানান, তাঁদের পাড়ায় ৩টি জনস্বাস্থ্য কারিগরের দফতরের কল থাকলেও, সেখানে দিনে দু’ঘণ্টা মাত্র জল পাওয়া যায়। কাজেই জলের জন্য লাইন দিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়, নয়তো দূরে ছুটতে হয় জলের জোগাড় করতে। বাবা-মায়ের এই জলকষ্ট মেটাতেই ববিতার মাথায় আসে কুয়োর কথা। তবে তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল খরচ। সাধারণত মিস্ত্রীরা ৫০০ টাকা প্রতি ফুট কুয়ো খননের জন্য পারিশ্রমিক নেন। দরিদ্র পরিবারে সেই অর্থ জোগাড় করাই যে দুষ্কর। তাই নিজেই সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ববিতা সোরেন।

গত ডিসেম্বরেই কাজ শুরু করেছিলেন ববিতা। তবে পাঁচ ফুটের বেশি আর মাটি খোঁড়া সম্ভব হয়নি। লকডাউনে বন্ধ কলেজ। এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে ১৪ জুন থেকে আবার পুরো উদ্যমে কাজ শুরু করেন তিনি। এই লকডাউনেই কাজ হারিয়েছেন তাঁর দিদিও। বাড়িতে মা এবং দিদির সাহায্য পেয়েই ববিতা দ্রুততার সঙ্গেই এগোতে থাকেন কাজ। দিনে প্রায় এক-দেড় ফুট করে মাটি কেটে ফেলেন তিনি। অবশেষে ২৩ জুন প্রায় ১৮ ফুট মাটি কাটার পর সন্ধান মেলে জলের। তবে তাঁর পরিকল্পনা রয়েছে অন্তত ২৪ ফুট খননের।

সাধারণত কুয়ো খননের সময় ধস প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয় কাঠ। সে সমস্যারও অভিনব সমাধান বার করেছেন ববিতা। উঠোন সংলগ্ন সেগুন গাছের ঠিক গোড়াতেই খুঁড়েছেন এই কুয়ো। ফলে গাছের শিকড় প্রাকৃতিক উপায়েই আঁকড়ে রাখবে মাটিকে, জানাচ্ছেন ববিতা। 

তাঁর এই জেদ এবং কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ প্রতিবেশীরা। এগিয়ে এসেছে প্রশাসনও। তাঁর কাজের ব্যাপারে জ্ঞাত হয়ে ছুটে গেছেন এলাকার বিধায়ক এবং বিডিও। ববিতাকে তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, এই কুয়োর বাকি কাজ সরকারি সাহায্যে সম্পূর্ণ করে দেওয়ার। পাশাপাশি এই উদ্যোগকে প্রশংসা জানিয়ে ববিতাকে জব সার্টিফিকেট বানিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন তাঁরা। তাঁকে দিয়েছেন একশো দিনের কাজে গাছ লাগানোর পরিকল্পনায় সুপারভাইজারের দায়িত্ব।

পরিবার থেকে পড়শি সকলেই যখন গর্বিত তাঁর এই কর্মকাণ্ডে, নিজে খানিকটা অবাকই হয়েছেন ববিতা। কুয়ো খননের জন্য এই সম্মান মিলবে তাঁর, নিজেও কখনো কল্পনা করেননি তিনি। 

আরও পড়ুন
খননের ফলে ২০০ বছরের প্রাচীন শিব মন্দির বেরিয়ে এল অন্ধ্রপ্রদেশে

Powered by Froala Editor